যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) জানিয়েছে, গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশি বর্বরতায় সরাসরি রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছিল।
সোমবার (২৭ জানুয়ারি) প্রকাশিত এক রিপোর্টে এই তথ্য জানিয়েছে সংস্থাটি। এছাড়া গত বছরের ওই আন্দোলনের সময় পুলিশের ভূমিকা মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের চেয়ে রাজনৈতিক নেতারা বেশি নির্ধারণ করে দিতেন বলেও রিপোর্টে উঠে এসেছে।
এমনকি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দীর্ঘদিন ধরে দায়মুক্তির ব্যবস্থা থেকে উপকৃত হওয়া শক্তিশালী এবং রাজনৈতিক নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে অন্তর্বর্তী সরকার লড়াই করছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া ডিরেক্টর ইলেইন পিয়ারসন বলেছেন, “গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে গিয়ে প্রায় ১০০০ বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। এটি বাংলাদেশে অধিকার-সমৃদ্ধ ভবিষ্যত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী সুযোগের সূচনা করেছে। কঠিন এই লড়াইয়ে জয়ের মাধ্যমে অর্জন করা সব অগ্রগতি হারিয়ে যেতে পারে যদি অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত এবং কাঠামোগত সংস্কার না করে। কাঠামোগত এমন সংস্কার করতে হবে যা ভবিষ্যত সরকারের যেকোনও দমন-পীড়নকে প্রতিরোধ করতে পারে।”
“আফটার দ্য মনসুন রেভোলিউশন: এ রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ” শিরোনামের এই প্রতিবেদনে বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়েছে যে— অতীতে কীভাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং নিরাপত্তা বাহিনী সবসময় রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
এইচআরডব্লিউকে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, তারা বিশ্বাস করেন— জুলাই-আগস্টের গণবিদ্রোহের সময় অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকেই এসেছে।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, “আমি বিশ্বাস করি, অস্থিরতার সময় পুলিশের ভূমিকা মাঠপর্যায়ের অফিসারদের চেয়ে রাজনৈতিক নেতারাই বেশি নির্ধারণ করে দিতেন।”
পুলিশের আরেক কর্মকর্তা এইচআরডব্লিউকে বলেছেন, তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের সিনিয়র অফিসারদের লাইভ সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে দেখেছেন এবং প্রতিবাদকারীদের গুলি করার জন্য অফিসারদের সরাসরি এমনভাবে নির্দেশ দিতে দেখেছেন যেন “তারা কাউকে ভিডিও গেমে গুলি করার নির্দেশ দিচ্ছেন।”
নাম প্রকাশ না করার৷ শর্তে অন্য একজন অফিসার বলেছেন, “ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদেরকে কঠোর হতে এবং ‘নৈরাজ্য ছড়ানো কোনও অপরাধী’কে রেহাই না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারা স্পষ্টভাবে ‘গুলি করো’ শব্দটি ব্যবহার করেননি, তবে তাদের নির্দেশাবলী স্পষ্ট ছিল: সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করুন, আপনি যা প্রয়োজন মনে করেন তা করুন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থান নিন।”
এইচআরডব্লিউকে তিনি বলেন, আন্দোলনের সময়কার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানকে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন, যিনি জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে তিনি বুঝতে পেরেছেন।
অন্য এক পুলিশ সদস্যের ভাষ্য, “আমি অফিসারদের আন্দোলনকারীদের অত্যাবশ্যক ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে দেখেছি… অনেক ক্ষেত্রে, অফিসারদের জীবন বিপদে না থাকলেও আমি তাদেরকে তাজা গোলাবারুদ ব্যবহার ও গুলিবর্ষণ করতে দেখেছি।”
এদিকে বলপূর্বক গুমের সাথে জড়িত কর্মকর্তারা এইচআরডব্লিউকে আরও বলেছেন, শেখ হাসিনা বা তার সরকারের সিনিয়র সদস্যরা এই ধরনের অসংলগ্ন আটকের বিষয়ে অবগত ছিলেন এবং কিছু ক্ষেত্রে হাসিনা সরাসরি বলপূর্বক গুম বা হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
নিরাপত্তা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা এইচআরডব্লিউকে বলেছেন, আবদুল্লাহিল আমান আজমির আটক এবং গোপন আটককেন্দ্রে থাকা অবস্থায় তার স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার বিষয়ে হাসিনা সরাসরি অবগত ছিলেন।
তিনি বলেন, আজমি সাবেক সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে তার সহকর্মী হওয়ায় তিনি শেখ হাসিনার কাছে তাকে (আজমিকে) মুক্তি দেওয়ার অনুমতি চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রতিবার তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন হাসিনা।
তিনি এইচআরডব্লিউর কাছে দাবি করেছেন, হাসিনা এমনকি আজমিকে হত্যা করার পরামর্শও দিয়েছেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, “আমি তা করিনি। কিন্তু আমি তার মুক্তির বিষয়ে (হাসিনার কাছে) আবেদন করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।”
অন্য একজন কর্মকর্তা বলেন, “আমার ১০-১১ বছরের চাকরি জীবনে, আমি র্যাবের হাতে গুম ও হত্যার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি। এগুলো বাস্তব। র্যাব যে গুম ও ক্রসফায়ারে জড়িত তা পুলিশ সদর দপ্তরের বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বা বিশেষ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়া অসম্ভব।”
এইচআরডব্লিউ মীর আহমেদ বিন কাসেমের (আরমান) সাক্ষাৎকার নিয়েছে যাকে ২০১৬ সাল থেকে জোরপূর্বক নিখোঁজ অবস্থায় রাখা হয়েছিল।
তিনি বলেছেন, তিনি এমন একজন অফিসারের মুখোমুখি হয়েছিলেন যিনি তাকে বলেছিলেন— যখন তিনি তার ইউনিটে যোগদান করেন তখন তাকে জানানো হয়েছিল, আরমান, আজমি এবং হুমাম কাদের চৌধুরীকে জোরপূর্বক গুম করা হয়েছে এবং বন্দি করে রাখা হয়েছে। এবং তাদের মুক্তির যে কোনও সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনাকেই নিতে হবে।
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, আজমি, হুম্মাম এবং আরমান সকলেই বিশিষ্ট বিরোধী রাজনীতিবিদদের সন্তান।