ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার প্রায় সাড়ে ছয় মাস পর হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। গণহত্যার অভিযোগ নিয়ে দলীয় প্রধান থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত নেতারা দেশে-বিদেশে পালিয়ে বেড়ানো অবস্থায় এই হরতালের ডাক দেওয়া হয়েছে দলের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে। তবে হরতালের পক্ষে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কোথাও আওয়ামী লীগের দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি।
আওয়ামী লীগের কথিত এই হরতাল কর্মসূচি শুরু হয়েছে মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) ভোর থেকে। দুপুর ১২টা নাগাদ হরতালের সমর্থনে কোথাও আওয়ামী লীগের কোনো তৎপরতার খবর পাওয়া যায়নি। গতকাল রাতে দেশের কয়েকটি স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে লুকিয়ে মশাল মিছিলের কয়েকটি ভিডিও আওয়ামী লীগের পেইজে ঘুরে বেড়ালেও হরতালের পক্ষে কোনো তৎপরতা সেখানেও চোখে পড়ছে না।
গত ২৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পদত্যাগ ও ‘অপশাসন-নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৮ ফেব্রুয়ারি হরতালের ডাক দেয় আওয়ামী লীগ। সেখানে পয়লা ফেব্রুয়ারি থেকেই মাঠে নামার ঘোষণা দেয় দলটি। তবে ফেব্রুয়ারির ১৮ দিন পেরিয়ে গেলেও আওয়ামী লীগের দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি।
কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ গত ৫ আগস্টের পর থেকে অনেকটা ছন্নছাড়া অবস্থায় রয়েছে। দলের নেতাদের অনেকেই পালিয়ে দেশ ছেড়েছেন। যারা দেশে আছেন তাদের কেউ কেউ গ্রেফতার হয়েছেন, বাকিরাও প্রকাশ্যে আসার সাহস পাচ্ছেন না। এই অবস্থায় হরতালের মতো কর্মসূচির ডাক দেওয়ায় আওয়ামী লীগের তৃণমূল ক্ষুব্ধ বলে জানা গেছে।
ঢাকার পাশের একটি জেলার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একজন স্থানীয় পর্যায়ের নেতা ক্ষোভের সুরে বলেন, ‘যারা দলকে অন্যায়-অপকর্ম করে ডুবিয়েছেন তারা তো দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। তারা বিদেশে বসে বসে এখন হরতালের মতো কর্মসূচি দিচ্ছেন। এতে আমাদের ওপর ধরপাকড় আরও বেড়ে গেছে। আমরা এই কর্মসূচির কারণে নতুন করে বিপদে পড়েছি।’ তার মতে আওয়ামী লীগের এখনই রাজপথের কর্মসূচি ঘোষণা সময় আসেনি। এর জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।
ভারতসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করা আওয়ামী লীগের নেতারা দেশে থাকা নেতাকর্মীদের রাজপথে নামার জন্য উদ্বুদ্ধ করছেন। কিন্তু নেতাদের কথায় খুব একটা সাড়া মিলছে না। এমনকি সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) রাতে ভারতে অবস্থান করা দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাও ভার্চুয়াল বৈঠকে হরতাল সফল করতে নেতাকর্মীদের মাঠে নামার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে দলীয় প্রধানের নির্দেশেও মাঠে নামার মতো দুঃসাহস করছেন না আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।
আওয়ামী লীগ অনেক বছর পর হরতালের মতো কর্মসূচিতে ফিরল। দলটি টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। এর আগে প্রায় দুই বছর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও হরতালের কর্মসূচি দেয়নি। ২০০৭ সালের জানুয়ারির পর তারা এই প্রথমবার এ ধরনের কোনো কর্মসূচি দিলো।
টানা প্রায় চার মেয়াদ ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর হরতাল-অবরোধ তারা কঠোরভাবে মোকাবেলা করেছে। তবে শত কঠোরতা সত্ত্বেও তখনকার বিরোধী দলগুলোর হরতাল-অবরোধের পক্ষে দৃশ্যমান কিছু পদক্ষেপ দেখা গেলেও আওয়ামী লীগের সেটাও দেখা যাচ্ছে না। জুলাই গণহত্যার জন্য দায়ী দলটির পক্ষে রাজনীতিতে ফেরা কঠিন হবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর প্রথমবার ১০ নভেম্বর নূর হোসেন দিবসে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মাঠে নামার নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। শহীদ নূর হোসেনের পাশাপাশি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবিও সঙ্গে নিয়ে আসতে বলা হয়েছিল৷ শেখ হাসিনা জানান, ট্রাম্পের ছবি নিয়ে মিছিলে বাধা দিলে সেই ছবি যেন ভালো করে তুলে রাখা হয়। তিনি সেই ছবি ট্রাম্পের কাছে পাঠাবেন, কারণ তার ট্রাম্পের সঙ্গে লিঙ্ক আছে।
তবে ১০ নভেম্বর জিরো পয়েন্টের কাছেও ভিড়তে পারেনি আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মী। দিনভর স্থানটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিরোধীদের দখলে ছিল। অনেকে এটাকে জিরো পয়েন্টে আওয়ামী লীগের জিরো পারফরম্যান্স হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এরপর ব্যাপক ধরপাকড়ের মুখে অনেকটা চুপসে যায় আওয়ামী লীগ। অনলাইনে গুজব ছড়ানো ছাড়া তাদের কোথাও সক্রিয় দেখা যায়নি।
এদিকে আওয়ামী লীগের কথিত হরতাল ঘিরে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী গতকালই নগরবাসীকে আশ্বস্ত করেছেন, আপনারা আতঙ্কিত হবেন না। তাদের হরতালে কিছুই হবে না।
আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজে ডাকা হরতাল নিয়ে পুলিশের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব প্রস্তুতি আছে। পুলিশের অতিরিক্ত ফোর্স মাঠে আছে। বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। কোনো কিছুতে নগরবাসী আতঙ্কিত হবেন না। খারাপ কোনো কিছু ঘটবে না।
সাজ্জাত আলী বলেন, ফেসবুকে দেখা যাচ্ছে মঙ্গলবার আওয়ামী লীগ হরতালের ডাক দিয়েছে। আমরা পুরো রাজধানীতে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছি। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। অতীতেও তারা (আওয়ামী লীগ) ফেসবুকে এমন প্রোগ্রাম দিয়েছে, আমরা তা মোকাবেলাও করেছি।