যাকাত ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের অন্যতম, যা মুসলমানদের ওপর ফরজ করা হয়েছে। এটি শুধু আর্থিক ইবাদত নয়; বরং সমাজের অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা। কুরআন ও হাদীসে যাকাতের অপরিসীম গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে, যা মুসলমানদের সম্পদের পবিত্রতা নিশ্চিত করে এবং দরিদ্রদের সহায়তা করে।
যাকাতের সংজ্ঞা ও বিধান
ইসলামি শরীয়তে যাকাত হল নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ থেকে নির্দিষ্ট অংশ দরিদ্র ও অভাবীদের মাঝে বিতরণ করা। সাধারণত সোনা, রূপা, নগদ অর্থ, ব্যবসায়িক পণ্য এবং কৃষিজ উৎপাদিত পণ্যের ওপর যাকাত ফরজ হয়, যদি তা নিসাব পরিমাণে পৌঁছে এবং এক বছর অতিক্রান্ত হয়।
কুরআন ও হাদীসে যাকাতের গুরুত্ব
আল্লাহ তাআলা কুরআনে বহুবার যাকাত প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন- “আর তোমরা নামাজ কায়েম করো এবং যাকাত আদায় করো এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু করো।” (সূরা আল-বাকারা: ৪৩)
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি স্তম্ভের ওপর স্থাপিত: (১) তাওহীদ ও রিসালাতে বিশ্বাস, (২) নামাজ কায়েম করা, (৩) যাকাত প্রদান করা, (৪) রমজানের রোজা রাখা, (৫) হজ পালন করা।” (বুখারি ও মুসলিম)
যাকাতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
যাকাত কেবল একটি ধর্মীয় কর্তব্য নয়, বরং এটি সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার একটি কার্যকর ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে। নিম্নে এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখ করা হলো:
১. দারিদ্র্য বিমোচন: যাকাত সমাজের অভাবী মানুষদের জীবনমান উন্নত করে এবং দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মুক্তি দেয়।
২. সম্পদের সুষম বণ্টন: এটি ধনীদের সম্পদের মধ্যে দরিদ্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে এবং সম্পদের প্রবাহ সচল রাখে।
৩. সম্পদের পবিত্রতা ও বরকত বৃদ্ধি: ইসলামে বলা হয়েছে, সম্পদ থেকে যাকাত আদায় করলে তা পবিত্র হয় এবং তাতে বরকত হয়।
৪. সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ বৃদ্ধি: যাকাত ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সহানুভূতির বন্ধন গড়ে তোলে।
৫. অপরাধ হ্রাস: অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোর মাধ্যমে চুরি, ডাকাতি, ও প্রতারণার মতো অপরাধ কমে যায়।
যাদের উপর যাকাত ফরজ
যাকাত ফরজ হয় সেই সকল মুসলিম নর-নারীর উপর যারা:
১. স্বাধীন: তারা যে স্বাধীন ব্যক্তি, অর্থাৎ দাস বা খোদার অধিকারী নয়।
২. জ্ঞানসম্পন্ন: তারা প্রাপ্তবয়স্ক (বালিগ) এবং মানসিকভাবে সুস্থ (আকিল)।
৩. নেসাব পরিমাণ মালের মালিক: তাদের উপর যাকাত ফরজ, যাদের নিকট সাড়ে সাততোলা সোনা (প্রায় ৮৮ গ্রাম) বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা (প্রায় ৬১৩ গ্রাম) বা সমপরিমাণ নগদ অর্থ বা সম্পদ এক বছর পর্যন্ত থাকে। তবে, তাদের ব্যবহৃত ঘর, পোশাক, আসবাবপত্র, আয়ের উৎস (যেমন গাড়ি, বাড়ি, মিল, ফ্যাক্টরি) ইত্যাদি এসব সম্পত্তি যাকাতের জন্য গণনা করা হয় না।
যদি কেউ এই শর্তগুলো পূর্ণ করেন, তবে তার উপর যাকাত ফরজ হবে। তবে, অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক-বালিকা বা মানসিকভাবে অক্ষম ব্যক্তির জন্য যাকাত ফরজ হবে না, যদিও তারা নিসাব পরিমাণ সম্পত্তির মালিক হন।
যারা যাকাত পাওয়ার যোগ্য
কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন:
“নিশ্চয়ই যাকাত فقير (অত্যন্ত দরিদ্র), مسكين (অভাবগ্রস্ত), যাকাত সংগ্রহকারীদের, ইসলাম গ্রহণকারীদের, দাস মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের জন্য নির্ধারিত।” (সূরা আত-তাওবা: ৬০)
অর্থাৎ সর্বমোট ৮ শ্রেণীর মানুষকে যাকাত দেওয়া যাবে।
তারা হলো:
১. ফকীর (অত্যন্ত দরিদ্র) – যারা একেবারেই নিঃস্ব এবং মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে অক্ষম।
২. মিসকীন (অভাবগ্রস্ত) – যারা উপার্জন করেন, কিন্তু মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর মতো পর্যাপ্ত সম্পদ নেই।
৩. যাকাত সংগ্রহকারী (আমিলীন আলাইহা) – যারা ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী যাকাত সংগ্রহ ও বিতরণের দায়িত্ব পালন করেন।
৪. মুয়াল্লাফাতুল কুলুব (ইসলামে নতুন প্রবেশকারী) – যারা সদ্য ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং আর্থিক সহায়তা পেলে ইসলামে দৃঢ় হতে পারেন।
৫. রিকাব (দাস মুক্তির জন্য) – যারা দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সাহায্যের প্রয়োজন।
৬. গারিমীন (ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি) – যারা বৈধ কারণে ঋণে জর্জরিত এবং তা পরিশোধের সামর্থ্য নেই।
৭. ফি সাবিলিল্লাহ (আল্লাহর রাস্তায় ব্যয়িত ব্যক্তি) – যারা ইসলামের প্রচার, জিহাদ বা অন্যান্য কল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত এবং অর্থনৈতিক সহায়তার প্রয়োজন।
৮. ইবনুস সাবিল (মুসাফির) – যারা সফরে আর্থিক সংকটে পড়েছেন এবং নিজ গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য সহায়তা প্রয়োজন।
যাকাত না দিলে তার শাস্তি ও বিধান
যাকাত ফরজ হওয়া সত্ত্বেও যদি কেউ তা আদায় না করে, তবে কুরআন ও হাদীসে এ সম্পর্কে কঠোর শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
কুরআনের সতর্কবাণী:
“যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও। সেই দিন জাহান্নামের আগুনে তা গরম করা হবে, তারপর তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দগ্ধ করা হবে এবং বলা হবে, ‘এটাই তোমাদের জন্য যা তোমরা জমা রেখেছিলে, এখন তোমরা যা জমা করতে তা ভোগ করো!’” (সূরা আত-তাওবা: ৩৪-৩৫)
হাদীসে ভয়াবহ শাস্তির বিবরণ:
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“আল্লাহ যাকে সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে তার সম্পদের যাকাত দেয়নি, কিয়ামতের দিন সে সম্পদ বিষাক্ত সাপের রূপ নেবে, যার চোখের উপর দুটি কালো বিন্দু থাকবে। তা তার গলায় পেঁচিয়ে দেওয়া হবে এবং সে তার চোয়াল দুটিতে কামড় বসাবে এবং বলবে: ‘আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার ধনভাণ্ডার।’” (বুখারি: ১৪০৩)
যাকাত ইসলামের একটি মহান বিধান, যা ধনীদের সম্পদে দরিদ্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। এটি শুধু অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষাই করে না, বরং মানুষের হৃদয়ে সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করে। সমাজে শান্তি, সাম্য এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের উচিত যথাযথভাবে যাকাত আদায় করা।
লেখক: তাওহীদ আদনান ইয়াকুব
ফাযেল, দারুল উলুম দেওবন্দ ও নদওয়াতুল উলামা লাখনৌ,
মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া আহলিয়া নশাসন, শরীয়তপুর