দীর্ঘদিন ধরে অন্তঃকোন্দলে আবদ্ধ থাকলেও সম্প্রতি নিজেদের মাঝে দু’ভাগে বিভক্তি দেখা দিয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। বিভিন্ন ইস্যুতে পারস্পরিক কোন্দল নিয়ে ক্যাম্পাসে দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সংগঠনটি। তবে ইফতার মাহফিলকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্যে দেখা দেয় দলীয় ফাটল। দুই মেরুতে অবস্থান শীর্ষ দলীয় নেতাদের। ফলে পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করতে দেখা যাচ্ছে তাদের। এতে দিশেহারা সাধারণ কর্মীরা।
জানা যায়, গত ২০২১ সালের ১৬ জুন শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতারা। এর পরদিনই (১৭ জুন, ২০২১) পদবঞ্চিত একাংশ নিয়ে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলন করেন সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক পদ পাওয়া আনোয়ার পারভেজ।
এসময় দলীয় নীতিমালা না মেনে বিবাহিত, অছাত্রদের পদ দেয়ার অভিযোগ তুলে এ কমিটি প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেয় পারভেজ সহ তার সহযোগিরা। এখান থেকে শুরু হয় বিভক্তি। এর পরে বিভিন্ন সময়ে পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেছে বিদ্রোহী এই গ্রুপকে।এর এক বছরের অধিক সময় পর কেন্দ্রের মধ্যস্থতায় উভয় পক্ষকে সমঝোতায় নিয়ে আসা হয়।
চলতে থাকে স্বাভাবিক দলীয় কার্যক্রম। গত ৫ নভেম্বর রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফা বাস্তবায়ন ও জনসাধারণের মধ্যে জনমত সৃষ্টির জন্য কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শিক্ষার্থীদের মধ্যে লিফলেট বিতরণ করে কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির।
এসময়ও ইবি শাখা ছাত্রদলকে একসাথে কাজ করার জন্য আহ্বান জানান তিনি।
গত ২৩ ফ্রেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় নির্দেশনায় ক্যাম্পাসে কর্মীসভার আয়োজন করার কথা থাকলেও তা সফল হয়নি। এনিয়েও ভাঙতে শুরু করে কর্মীদের মনোবল। এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের ওপর দায় চাপানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি করে।
তবে সম্প্রতি (৪ মার্চ) বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার নিয়োগকে কেন্দ্র করে উপ-উপাচার্য এবং প্রক্টরের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এসময় সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহে বাধা প্রদানের মতো ঘটনা-সহ উপাচার্যের কার্যালয়ে হট্টগোল সৃষ্টি হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের মাঝে আবারও দায় চাপানোর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
এক পর্যায়ে যুগ্ম আহ্বায়ক পারভেজ এ ঘটনার জন্য আহ্বায়ক সাহেদ আহম্মেদকে দায়ী করে সাংবাদিকদের বলেন, “প্রো-ভিসি, আহ্বায়ক সাহেদ, সদস্য সচিব মিথুন তাদের ব্যক্তিস্বার্থে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে রেজিস্ট্রার বানাতে উঠেপড়ে লেগেছে। আমরা চাই জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের যোগ্য একজন ব্যক্তিকে রেজিস্ট্রার বানানো হোক। আর সাংবাদিকদের সাথে নিজ দলের কর্মীদের চেয়েও খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে। আমি এর তীব্র নিন্দা জানাই। আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের এমন আচরণের দায় ইবি ছাত্রদল নেবে না।”
এরপর থেকে দুই গ্রুপের মধ্যে সৃষ্টি হয় দা-কুমড়া সম্পর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দলীয় গ্রুপ থেকে আনোয়ার পারভেজকে রিমুভ করে দেয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে। ইতোমধ্যে দু’গ্রুপে মধ্যে আলাদাভাবে কর্মসূচি পালন করা শুরু হয়েছে।
এদিকে গত ৮ মার্চ শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সাহেদ আহম্মেদের নেতৃত্বে সাংবাদিকদের নিয়ে আয়োজন করা হয় ইফতার কর্মসূচি। এ কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন না আনোয়ার পারভেজ ও তার অনুসারীরা। এ নিয়ে দৃশ্যমান হয় তাদের বিভক্তি। এদিকে কেন্দ্রে ঘোষিত ১০ মার্চ আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের নেতৃত্বে ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে সংগঠনটি। এই কর্মসূচিতেও উপস্থিত ছিলেন না আনোয়ার পারভেজ ও তার অনুসারীরা।
পক্ষান্তরে গত মঙ্গলবার (১১ মার্চ) বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিকদের নিয়ে পৃথকভাবে ইফতার কর্মসূচির আয়োজন করেন শাখা সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ার পারভেজ ও তার অনুসারীরা। পাশাপাশি একই দিনে ক্যাম্পাসে নিম্ন আয়ের লোকদের মাঝে ইফতার বিতরণ করেছে তার (পারভেজ) নেতৃত্বে।
একাধিক কর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বর্তমান কর্মীরা দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে। দলীয় ব্যানার যেখানে পায় সেখানেই ছুটে যাচ্ছে। ব্যক্তি হিসেবে না দেখে দলীয় ব্যানারে কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে কর্মীরা। ভালো কাজের কর্মসূচি যে গ্রুপের হোক না কেন- ছুটে যাবে বলে প্রত্যায় তাদের। এক গ্রুপ অন্য গ্রুপকে না জানিয়ে কর্মসূচি দেয়া হচ্ছে বলে জানান সংগঠনটির কর্মীরা।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে শাখা সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ার পারভেজ বলেন, “ব্যক্তি হিসেবে উদ্যোগ সবাই নিতে পারে। তবে আমার প্রতিটি কাজের পরিচয় বহন করে ছাত্রদল। কেন্দ্রে যা সিদ্ধান্ত দিবে তা মাথা-পেতে নিব। আমাকে ব্যক্তি আক্রোশে আহ্বায়ক কমিটির গ্রুপ থেকে রিমুভ দিয়েছে। এটা কি আহ্বায়ক কমিটির এখতিয়ার রাখে কিনা প্রশ্ন রাখছি।”
তিনি আরও বলেন, “কেন্দ্র ঘোষিত কোনো প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করতে পারছে না। অধিকাংশ কর্মী নিষ্ক্রিয়। কোনো প্রোগ্রামে আমাকে জানায় না। আমি কি কর্মী? আমি আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের পরে ৩ নাম্বারে আছি। অথচ যেকোনো প্রোগ্রামে আমার কর্মী থাকে বেশি। আহ্বায়ক তো যেকোনো কর্মসূচিতে ৫ জনের বেশি বের করতে পারে না। প্রতিহিংসা বলতে কোনো শব্দ নেই। রাজনৈতিক মাঠে লড়াই করে যাব।”
গ্রুপিংয়ের প্রশ্নে তিনি জানান, “মাঠে সবাই সমান। রোল ১, ২ ও ৩ এর মতো। কিন্তু সবাই একই ক্লাসের। আমি বঞ্চিতদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। সেইদিন নারী ধর্ষণের প্রোগ্রামে আমাকে বলেনি৷ কেন্দ্রে যখন অবহিত করেছি তখন পৃথকভাবে প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের জন্য ক্যাম্পাসে অনুমোদন দেয়া হয়নি। সেজন্য আমি যাইনি।”এনিয়ে কমিটির আহ্বায়ক সাহেদ আহম্মেদ মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে একই প্যানেলের সদস্য সচিব মাসুদ রুমী মিথুন বলেন, “ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজের মতো করে কাজ করতে পারে। তবে যখন পৃথক ব্যানারের প্রশ্ন আসবে তখন শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজের জন্য কেন্দ্র দেখবে।” তিনি আরও জানান, “সে (পারভেজ) তো আগে থেকেই সভাপতি সেক্রেটারির কথা মানে না। যেহেতু কমিটি মানে না বা কোনো কাজে আসতেছে না, নিজস্ব গ্রুপ থেকে রিমুভ দেয়া হয়েছে। শুরু থেকে কমিটিকে সে প্রত্যাখ্যান করেছে, এখনও উইথড্র করেনি। নিজের মতো করে কাজ করে যাচ্ছে। সে যদি আমাদের সাথে কাজ করতে চায় সবসময় ওয়েলকাম। আমরা কেন্দ্র ঘোষিত প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। তার মতো যুগ্ম আহ্বায়ক অনেকে আছে, সবার সাথে পরামর্শ নেয়া সম্ভব? ওর সাথে পরামর্শ নিতে গেলে নিজের সিদ্ধান্তই চাপিয়ে দেয়।”