জায়নবাদী ইসরায়েল আর হিন্দুত্ববাদী ভারতের মধ্যে কোনও ফারাক নেই বলেই মন্তব্য করেছেন একজন ভারতীয় সাংবাদিক।
শনিবার (২২ মার্চ) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে তিনি এ কথা বলেন।
ফেস দ্যা পিপল পাঠকদের জন্য ভারতীয় সাংবাদিক অর্ক ভাদুরীর স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হল-
‘সংবিধানে যাই থাক, নরেন্দ্র মোদীর ভারত আদতে একটি হিন্দু রাষ্ট্র। মোদীর ভারতে মুসলিমরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক৷ ‘গুড মুসলিম’ হলে তাঁর হেনস্থা একটু কম হবে৷ না হতে পারলে ভোগান্তি বাড়বে৷ গত এক দশকে ভারত নিজেকে দক্ষিণ এশিয়ার ইজরায়েলে পরিণত করেছে৷ মুসলিমরা এই দেশে ‘অপর’, তাঁরা দেশের যাবতীয় উন্নতির ‘শত্রু’, দেশের ভিতরে থাকা দেশদ্রোহী- এই বয়ান সমাজের সর্বস্তরে, এমনকি তথাকথিত প্রগতিশীল পরিসরেও যে বিপুল সমর্থন পেয়েছে, মুসলিম বিদ্বেষ যে পরিমাণ সামাজিক সম্মতি উৎপাদন করতে পেরেছে, তা অভূতপূর্ব। প্যালেস্টাইনের চলমান গণহত্যা, শিশুমেধ যজ্ঞের প্রতি ভারতের বিপুল সংখ্যক মানুষের সমর্থন আদতে একটি চমৎকার প্যারামিটার, যা বুঝিয়ে দেয় জায়নবাদী ইজরায়েল এবং হিন্দুত্ববাদী ভারতের মধ্যে তেমন কোনও ফারাক নেই।’
‘এতে অসুবিধার কিছু নেই। যাঁরা এই হিন্দু রাষ্ট্র প্রকল্পের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন, তাঁরা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই দাঁড়াচ্ছেন৷ তাঁরা জানেন এই যুদ্ধে জেতা কঠিন, কিন্তু যুদ্ধটা করে যেতে হবে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন বিধবা বিবাহের পক্ষে পথে নেমেছিলেন, তখন তাঁর বিরুদ্ধেই ছিলেন অধিকাংশ মানুষ৷ ভারতে বসে যাঁরা ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরোধিতা করবেন, হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলবেন, তাঁরা সংখ্যালঘুই থাকবেন৷ তাঁরাই গৌরী লঙ্কেশ, তাঁরাই কালবুর্গি। তাঁরা ইতিহাসের বিচারে সঠিক পক্ষে আছেন৷ ঝুঁকি নিয়েই আছেন।’
‘সম্প্রতি হোলি উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে সংখ্যাগুরুর পেশি প্রদর্শন করা হল। উত্তরপ্রদেশের উন্নাওতে ৪৮ বছর বয়সী মহম্মদ শরিফ গণপিটুনির শিকার হয়েছেন বলে তাঁর পরিবারের দাবি৷ ভদ্রলোক মারা গিয়েছেন৷ তাঁর ‘অপরাধ’ ছিল তিনি রং মাখতে চাননি৷ পুলিশ অবশ্য গণপিটুনির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। বলেছে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মৃত্যু। সংখ্যাগুরু রং খেলবে বলে উত্তরপ্রদেশের মসজিদগুলি ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এর চেয়ে লজ্জার দৃশ্য আর কি হতে পারে? একদম সরাসরি বুঝিয়ে দেওয়া হল, ভারতে থাকতে হলে এগুলি মেনে নিয়ে, মাথা নিচু করে, দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়েই থাকতে হবে মুসলমানদের।’
‘এই সবকিছু তো একদিনে হয়নি৷ একটু একটু করে হয়েছে। অনেক বছর ধরে। আখলাক, আফরাজুলকে খুন হতে হয়েছে। আসানসোলের ইমাম রশিদিকে সন্তান হারাতে হয়েছে। মালদহের বাসিন্দা জামাল মোমিনকে ট্রেনে ঘিরে ধরে বুলি করা হয়েছে, একটানা চড়থাপ্পড় মারা হয়েছে। মসজিদের উপরে গেরুয়া পতাকা পুঁতে দেওয়া হয়েছে৷ আমরা একটার পর একটা দাঙ্গা দেখেছি। মূলতঃ স্মল স্কেল রায়ট। ছোট ছোট দাঙ্গা৷ ইনভেস্টমেন্ট কম৷ কিন্তু আতঙ্ক ছড়ানো যায় বেশি। সংখ্যালঘুদের ক্রমাগত বুঝিয়ে দেওয়া, ‘তুমি সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন, চাকরবাকর। তুমি ঠিক মানুষ নও। মনুষ্যেতর কিছু। থাকতে হলে চড়থাপ্পড় খেয়ে থাকো।’ এগুলি চলছে অনেকদিন ধরে। অথচ কোনও কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি। মসজিদ আর উন্মত্ত জনতার মাঝে ঢাল হয়ে দাঁড়ানোর ছবি চোখে পড়েনি৷ অন্য দেশে কিন্তু এমন হয়েছে মন্দিরের সামনে৷ আমরা পারিনি৷ ফ্যাসিস্ট যখন ক্ষমতা দখল করে, তখন সবচেয়ে আগে দখল হয় মগজ, বিবেক, চেতনা৷ কাজেই বেদখল হওয়া মগজে ঘৃণার চাষ ভালো হবেই।’
‘শুভেন্দু অধিকারী সম্প্রতি বলেছেন, বিজেপি ক্ষমতায় এলে মুসলিম বিধায়কদের চ্যাংদোলা করে ছুঁড়ে ফেলবেন৷ ভুল কিছু বলেননি। এরকম হয়। ইজরায়েলের কমিউনিস্ট পার্টি ‘মাকি’র সাংসদ ওফের কাসিফ, যিনি ইজরায়েলের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্যালেস্টাইনের পক্ষে সরব, তাঁকে বহুবার এরকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ভারতেও তো গুজরাট গণহত্যার সময় পুড়িয়ে মারা হয়েছে মুসলিম সাংসদকে। কাজেই এগুলো নতুন কিছু নয়। এরকম হয়েই থাকে।’
‘যখন ছোট ছিলাম, ‘কচি সাংবাদিক’ ছিলাম, তখন খুব করে ‘সম্প্রীতি’র খবর লিখতাম। খুঁজে খুঁজে আনতাম কোথায় মুসলিমরা অংশ নিয়েছেন হিন্দুদের পুজোয়, কোথায় মসজিদের চাতালে দুর্গাপুজো হচ্ছে৷ এখন সময় পাই না৷ ইচ্ছেও করে না। ভীষণ আরোপিত মনে হয়। জোর করা আঁকা ছবি যেন৷ তার মধ্যেই আউটলুকে একটা চমৎকার লেখা পঠলাম৷ লুবনা জেরার নকভি লিখেছেন পাকিস্তানের হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির গল্প। করাচির মাহেশ্বরী কমিউনিটির কথা লিখেছেন, যাঁরা ইফতার অর্গানাইজ করেন৷ সিন্ধের গর্ভনরের কথা লিখেছেন, যিনি গ্র্যান্ড ইফতার থেকে হোলির শুভেচ্ছা জানিয়েছেন৷ কুবি এলাকার চান্ডিও পরিবারের কথা লিখেছেন, যাঁরা ৫ দশক ধরে মন্দির আগলাচ্ছেন৷ ঘোটকির সাচো সাত্রাম দাস মন্দিরে ‘তৌহিদি জনতা’র হামলার কথা লিখেছেন, যেই ঘটনায় ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন স্থানীয় মুসলিমরা৷’
‘এগুলি পড়তে ভালো লাগে৷ সেই সঙ্গে মনে হয়, কেন সংখ্যালঘুকেই সম্প্রীতি রক্ষার পরীক্ষা দিতে হবে? কেন এদেশের মুসলিমদের বার বার করে বলতে হবে তাঁরা পাকিস্তানের সমর্থক নন? বিশেষ করে এমন একটা দেশে তাঁরা থাকেন, যেখানে সংখ্যাগুরু রং খেলবে বলে মসজিদগুলি ঢেকে দেওয়া হয়! আসলে তো মুখ ঢাকে ভারতের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা। এমন একটা দেশে তাঁরা থাকেন, যেখানে টেলিভিশন চ্যানেলের সান্ধ্য-খেউড়ের আসরে তাঁদের গোটা কমিউনিটিকে ক্রিমিনাল বানানো হয়৷’
‘শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন তাঁর মুসলমানদের ভোট দরকার নেই৷ ভালো কথা। খুব কাছাকাছি ধরণের কথা বলেছিলেন গোটাবায়া রাজাপাক্ষে। তাঁরও নাকি তামিলদের ভোট দরকার ছিল না৷’
‘এই কথা বলার কিছুদিন পরে রাজাপাক্ষে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল৷ তাঁর প্রাসাদে জলকেলি করেছিল শ্রীলঙ্কার জনতা৷’
‘কাজেই কখন যে কী হয়, কে বলতে পারে! হঠাৎ করেই তো কত কী ঘটে যেতে পারে। তাই না? যতদিন তা না ঘটছে, শান্তিকুঞ্জে শান্তি বর্ষিত হোক।’