গাজার মুসলিমদের প্রতি সংহতি জানিয়ে মার্চ ফর গাজা কর্মসূচিতে রাজধানী ঢাকায় জনতার এক মহাসমুদ্র তৈরি হয়। এ কর্মসূচিতে অংশ নিতে গতকাল রাতেই সারাদেশে থেকে রাজধানীতে অবস্থান নিতে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ, সকাল থেকে নগরীর মিরপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, বাংলামোটর ও শাহবাগ পয়েন্টে জড়ো হয়ে খন্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থল একত্রিত হয় জনতার মিছিল। পিকআপ ভ্যানে করে তরুণদের স্লোগান দিতে দিকে উদ্যানের দিকে যেতে দেখা গেছে।
শনিবার (১২ এপ্রিল) রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে ‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট বাংলাদেশ’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম। বিকাল ৩টা থেকে ‘মার্চ গর গাজা’ কর্মসূচি শুরু হয়। ‘ফ্রি ফ্রি প্যালেস্টাইন’, ‘আল জিহাদ’, আল জিহাদ, ‘তেরা মেরা রিস্তা ক্যা, লা ইলাহা ইলল্লাহ’, ফ্রম দ্যা রিভার টু দ্যা সি, প্যালেস্টাইন উইল বি ফ্রি’ স্লোগান দিতে থাকেন উপস্থিত জনতা। বিকেল চারটার কিছু পরে ঘোষণাপত্র পাঠের মধ্য দিয়ে কর্মসূচি শেষ হয়। আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ঘোষণাপত্র পাঠ করেন ও বক্তব্য দেন।
মাহমুদুর রহমানের পাঠ করা ঘোষণাপত্র ও অঙ্গীকারনামাটি নিচে হুবহু তুলে ধরা হলো-
বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম। আল্লাহর নামে শুরু করছি, যিনি পরাক্রমশালী, যিনি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকারী, যিনি মজলুমের পাশে থাকেন, আর জালেমের পরিণতি নির্ধারণ করেন।
আজ আমরা, বাংলাদেশের জনতা-যারা জুলুমের ইতিহাস জানি, প্রতিবাদের চেতনা ধারণ করি-সমবেত হয়েছি গাজার মৃত্যুভয়হীন জনগণের পাশে দাঁড়াতে। আজকের এই সমাবেশ কেবল প্রতিবাদ নয়, এটি ইতিহাসের সামনে দেওয়া আমাদের জবাব, একটি অঙ্গীকার, একটি শপথ।
এই পদযাত্রা ও গণজমায়েত থেকে আজ আমরা চারটি স্তরে আমাদের দাবিসমূহ উপস্থাপন করব-
আমাদের প্রথম দাবিগুলো জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি। যেহেতু-জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সকল জাতির অধিকার রক্ষার, দখলদারিত্ব ও গণহত্যা রোধের সংকল্প প্রকাশ করে; এবং-আমরা দেখেছি, গাযায় প্রতিদিন যে রক্তপাত, যে ধ্বংস চলছে, তা কোনো একক সরকারের ব্যর্থতা নয়-বরং এটি একটি আন্তর্জাতিক ব্যর্থতার ফল; এবং-এই ব্যর্থতা শুধু নীরবতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়-বরং পশ্চিমা শক্তিবলয়ের অনেক রাষ্ট্র সরাসরি দখলদার ইজরায়েলকে অস্ত্র, অর্থ ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে এই গণহত্যাকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে; এবং-এই বিশ্বব্যবস্থা দখলদার ইজরায়েলকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে বরং রক্ষা করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে; সেহেতু আমরা জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি জোরালো দাবি জানাচ্ছি।
এবং-গাযা আমাদের জন্য এক আয়না-যেখানে আমরা দেখতে পাই, কীভাবে বিশ্বাসী হওয়া মানে কেবল বেঁচে থাকা নয়, সংগ্রামে দৃঢ় থাকা; সেহেতু আমরা এই মাটির মানুষ, এই মুসলিম ভূখণ্ডের নাগরিক, এই কওমের সন্তান এবং সর্বোপরি মুসলিম উম্মাহর সদস্য-একটি অঙ্গীকার করছি:
১। আমরা সকলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বয়কট করবো-প্রত্যেক সেই পণ্য, কোম্পানি ও শক্তিকে যারা ইজরায়েলের দখলদারিত্বকে টিকিয়ে রাখে;
২। আমরা আমাদের সমাজ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রস্তুত করবো-যারা ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর সকল প্রতীক ও নিদর্শনকে সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার করবে, ইনশাআল্লাহ;
৩। আমরা আমাদের সন্তানদের এমনভাবে গড়ে তুলবো-যারা নিজেদের আদর্শ ও ভূখণ্ড রক্ষায় জান ও মালের সর্বোচ্চ ত্যাগে প্রস্তুত থাকবে;
৪। আমরা বিভাজিত হবো না-কারণ আমরা জানি, বিভক্ত জনগণকে দখল করতে দেরি হয় না।
আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকবো, যাতে এই বাংলাদেশ কখনো কোনো হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পের পরবর্তী গাজায় পরিণত না হয়।
আমরা শুরু করবো নিজেদের ঘর থেকে-ভাষা, ইতিহাস, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, সমাজ-সবখানে এই অঙ্গীকারের ছাপ রেখে।
আমরা মনে রাখবো: গাযার শহীদরা কেবল আমাদের দোয়া চান না-তাঁরা আমাদের প্রস্তুতি চান।
শেষকথা:
শান্তি বর্ষিত হোক গাযার সম্মানিত অধিবাসীদের উপর-তাঁদের উপর, যাঁরা নজিরবিহীন সবর করেছেন, যাঁরা অবিচল ঈমানের প্রমাণ দিয়েছেন। যাঁরা ধ্বংসস্তূপের মাঝেও প্রতিরোধের আগুন জ্বেলেছেন।
বিশ্বের নীরবতা ও উদাসীনতার যন্ত্রণা হাসিমুখে বুকের মাঝে ধারণ করেছেন। শান্তি বর্ষিত হোক তাদের উপর, যাঁরা নাম রেখে গেছেন ইজ্জতের খতিয়ানে-
শান্তি বর্ষিত হোক হিন্দ রজব, রীম এবং ফাদি আবু সালেহ সহ সকল শহীদেরর উপর, যাঁদের রক্ত দ্বারা গাজার পবিত্রভূমি আরো পবিত্র হয়েছে, যাঁদের চোখে ছিল প্রতিরোধের অগ্নিশিখা।
শান্তি বর্ষিত হোক বাইতুল মাকদিসের গর্বিত অধিবাসীদের উপর, যাঁদের হৃদয়ে এখনো ধ্বনিত হয় ‘আল-কুদস লানা’, আল কুদস আমাদের!
গাজার জনগণকে অভিনন্দন-
আপনারা ঈমান, সবর আর কুরবানীর মহাকাব্য রচনা করেছেন। দুনিয়াকে দেখিয়েছেন-ঈমান আর তাওয়াক্কুলের শক্তি আমরা, বাংলাদেশের মানুষ-শাহ জালাল আর শরীয়াতুল্লাহর ভূমি থেকে দাঁড়িয়ে, আপনাদের সালাম জানাই, আপনাদের শহীদদের প্রতি ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা জানাই, আর আমাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় এই দো’আ-হে আল্লাহ, গাজার এই সাহসী জনপদকে তুমি সেই পাথর বানিয়ে দাও, যার উপর গিয়ে ভেঙে পড়বে জায়োনিস্টদের সব ষড়যন্ত্র।
বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণের পক্ষে, প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট, বাংলাদেশ।
কর্মসূচিতে ইসলামিক স্কলার ও বক্তা ড. মিজানুর রহমান আজহারী মার্চ ফর গাজার মঞ্চ থেকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা চেয়ে স্লোগান দিয়েছেন। প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন বিশিষ্ট আলেম শায়খ আহমাদুল্লাহ। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, যুগ্ম-মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি। এছাড়াও এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি বিশাল র্যালি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়েছেন। যেখানে সাথে ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত বাংলাদেশি কারী আহমাদ ইউসুফ আল-আজহারী, জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমীর নুরুল ইসলাম বুলবুল প্রমুখ।
ঢাকার বিভিন্ন থানা, ইউনিয়ন, মসজিদ ও মাদ্রাসা থেকে আগত হাজারো মানুষ এই র্যালিতে অংশগ্রহণ করেন। তাদের হাতে ছিল ফিলিস্তিন ও কালেমার পতাকা; প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল— “Free Palestine”, “Stop the Genocide”, “Save Gaza”। স্লোগানে স্লোগানে গর্জে উঠছিল সোহরাওয়ার্দীর প্রতিটি পথ ও প্রান্তর।
এ সপ্তাহের শুরুর দিকে ফেসবুকে ‘মার্চ ফর গাজা’ নামে একটি ইভেন্ট পেজ তৈরি করেছে প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট, বাংলাদেশ। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, বিভিন্ন সংগঠন, ইসলামি বক্তা ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে, আজ মঞ্চে এই কর্মসূচিতে সংহতি জানানো বিভিন্ন দলের নেতারা উপস্থিত হতে দেখা যায়।
ফিলিস্তিনের গাজায় মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম হত্যাযকজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে দখলদার ইসরায়েল। সারা বিশ্বজুড়েই প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, বাংলাদেশও সর্বোচ্চ উপস্থিতি দিয়ে নিজেদের একাত্মতা পেকাশ করেছেন।