বর্ষীয়ান আলেম, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব, বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা, জামেয়া দারুল মাআরিফ আল ইসলামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও মহাপরিচালক এবং আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশের সভাপতি আল্লামা সুলতান যওক নদভী ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
শুক্রবার (২ মে) দিবাগত রাতে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।
শনিবার বিকেল ৪টায় জামেয়া দারুল মাআরিফ আল ইসলামিয়া (মাদরাসা) প্রাঙ্গণে তাঁর জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হবে।আল্লামা সুলতান যওক নদভী দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা অসুস্থতায় ভুগছিলেন।
গত ১৮ এপ্রিল গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে চট্টগ্রামের এভারকেয়ার হাসপাতালের স্পেশাল ডিজিজ ইউনিটে (এসডিইউ) ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেখানেই তিনি ইন্তেকাল করেন।
আল্লামা সুলতান যওক নদভী ছিলেন দেশের কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার একজন প্রভাবশালী সংস্কারক, বিশিষ্ট আরবি ভাষাবিদ, খ্যাতিমান শিক্ষক ও চিন্তাশীল গবেষক। একইসঙ্গে তিনি ছিলেন রাবেতা আল আলাম আল ইসলামি এর বাংলাদেশ শাখার প্রধান এবং রাবেতায়ে আল-আদাব আল-ইসলামির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য।
আল্লামা সুলতান যওক নদভী ১৯৩৭ সালে কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার জাগীরাঘোনা মহল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শৈশবেই হিফজুল কুরআন সম্পন্ন করেন এবং কওমি মাদ্রাসা শিক্ষায় হাতেখড়ি নেন। ১৯৫৯ সালে আল-জামেয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া থেকে দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল) সম্পন্ন করেন।পরবর্তীতে উচ্চতর আরবি ভাষা ও সাহিত্যে দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে তিনি ভারতের দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামা থেকে ১৪০৪ হিজরিতে সম্মানসূচক ‘আলমিয়াত’ ডিগ্রি অর্জন করেন।
তিনি ছিলেন বাংলাদেশের কওমি অঙ্গনের প্রথম সারির আলেমদের অন্যতম, যিনি আরবি সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা ও প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।
আল্লামা নদভী ১৯৫৯ সালে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার মাদ্রাসা রাশিদিয়াতে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। ১৯৬০ সালে তিনি যোগ দেন জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জে। এরপর ১৯৬২ সালে হাজী মুহাম্মদ ইউনুস (রহ.) এর আহ্বানে পটিয়া আল-জামেয়া আল-ইসলামিয়ায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৬৫ সালে তিনি একটি আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠনের উদ্দেশ্যে পটিয়া ত্যাগ করেন এবং চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকায় “কাশেমুল উলুম” নামে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তিনি হাটহাজারীর বাবুনগর এলাকায় আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া আজিজুল উলুমে শিক্ষকতা করেন এবং সেখানে নাদিয়াতুল আদাব নামে একটি সাহিত্য শিক্ষাকেন্দ্র চালু করেন।বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর তিনি আবারও পটিয়া মাদ্রাসায় ফিরে আসেন। সে সময় তিনি “আস-সুবহুল জাদিদ” নামে একটি ত্রৈমাসিক আরবি পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, যা কওমি অঙ্গনে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার এক বিশেষ ক্ষেত্র সৃষ্টি করে।
১৯৮১ সালে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সেমিনারে অংশগ্রহণের জন্য তিনি ভারত সফর করেন এবং নদওয়াতুল উলামায় দুই মাস অবস্থান করেন। ১৯৮৪ সালে তাঁর আমন্ত্রণে বিশ্বখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ আবুল হাসান আলী হাসানী নদভী বাংলাদেশ সফর করেন এবং মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দেন।১৯৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম শহরে প্রতিষ্ঠা করেন “জামেয়া দারুল মাআরিফ আল ইসলামিয়া” যা বর্তমানে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। একইসঙ্গে তিনি আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আল্লামা নদভীর পরিচিতি ছিল ব্যাপক। ১৯৮৬ সালে তিনি রাবেতায়ে আল-আদাব আল-ইসলামির ট্রাস্টি বোর্ডে সদস্য নির্বাচিত হন এবং বাংলাদেশের আঞ্চলিক কার্যালয়ের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এছাড়াও রাবেতা আল আলাম আল ইসলামি এর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং তিনি সংগঠনটির বাংলাদেশ শাখার প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
আরবি ভাষা, সাহিত্য ও ইসলামি জ্ঞানে তার অসামান্য অবদান রয়েছে। তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন, তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য বইসমূহ হলো আত্ব-তরীকু ইলাল ইনশা, আমার জীবনকথা, আল-ক্বিরাআতুল আরাবিয়্যাহইশরুনা দারসান, তাছহিলুল ইনশাসহ আরও বহু গ্রন্থ। এইসব বই কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যসূচি ও সাহিত্যচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
তার ইন্তেকালে ইসলামি অঙ্গনে অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি হলো।আল্লামা সুলতান যওক (রহ.) এর মৃত্যুতে ইতিমধ্যে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা ড. আফম খালেদ হোসেন।
তিনি তাঁর ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইলে লিখেছেন, “আমার শায়খ, আমার উস্তাদ আল্লামা সুলতান যওক নদভী রহ. আর নেই। আল্লাহ তায়ালা হযরতকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন, আমিন।”
এছাড়াও দেশ-বিদেশের ইসলামী ব্যক্তিত্ব, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে গভীর শোক প্রকাশ করা হচ্ছে।