ছাত্র ও জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সোমবার (১২ মে) বিকেলে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, এর অঙ্গসংগঠন এবং দলটির সমর্থকদের যেকোনো রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ থাকবে।
এই নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত আসে গত শনিবার (১০ মে) রাতে উপদেষ্টা পরিষদের এক জরুরি বৈঠকের পর। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে চলা ওই বৈঠকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের বিচার চলাকালীন তাদের কার্যক্রম স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরে রাত ১১টায় অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানান।
লিখিত বক্তব্যে ড. আসিফ নজরুল জানান, ১০ মে তারিখে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। সংশোধিত আইনে রাজনৈতিক দল, তাদের অঙ্গসংগঠন এবং সহযোগী গোষ্ঠীগুলোকে বিচারের আওতায় আনার সুযোগ রাখা হয়েছে।
আইন উপদেষ্টা আরও বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব, এবং ‘জুলাই আন্দোলনে’ নেতৃত্বদানকারী ছাত্র-জনতা ও ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্যদাতা ব্যক্তিদের সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দলটির সাইবারস্পেস-সহ সবধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকবে এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এছাড়াও, উপদেষ্টা পরিষদের সভায় আগামী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ চূড়ান্ত ও প্রকাশের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী ঐতিহাসিক দল আওয়ামী লীগ টানা ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার সময় একাধিক অনিয়ম, দমন-পীড়ন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের মুখে পড়ে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে শুরু হওয়া গণআন্দোলন দমন করতে গিয়ে দলের নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মিলে সহিংস পন্থা গ্রহণ করে বলে অভিযোগ ওঠে। ওই সময়ের সহিংসতায় এক হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানির কথা জানা যায়। পঙ্গু হয়ে যান হাজার হাজার মানুষ, যাঁরা এখনও মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
পরিস্থিতি চরমে পৌঁছায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। ওইদিন ছাত্র ও জনতার গণআন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার পতন হয়। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এরপর থেকেই দলটি কার্যত ভেঙে পড়ে। বিভিন্ন নেতাকর্মী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, কেউ কেউ গ্রেফতার হন, বাকিরা আত্মগোপনে চলে যান। বর্তমানে দলটির অধিকাংশ নেতাকর্মী প্রকাশ্যে আসার সাহস পাচ্ছেন না। আওয়ামী লীগের পরিচয় দেওয়ার মতো পরিস্থিতিও নেই তাদের সামনে।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি দীর্ঘদিন ধরেই উঠে আসছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক মহল থেকে। ইতিমধ্যে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল সরাসরি নিষেধাজ্ঞার বিপক্ষে অবস্থান নিলেও, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে দেয় সমীকরণ।
বিশেষ করে ৭ মে গভীর রাতে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগের পর এই দাবি আরও জোরালো হয়। এর জেরে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা আবারও মাঠে নামে। তাঁরা প্রথমে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নেন, পরে শাহবাগ মোড়েও বিক্ষোভ চালিয়ে যান। একই দাবিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
এই প্রেক্ষাপটেই শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সাড়া দিয়ে এবং জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার প্রজ্ঞাপন জারি করে।