আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর জন্য দোয়া করায় বরখাস্ত হয়েছিলেন মেহেরপুরের গাংনী মডেল মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা ইলিয়াছ হোসেন। অথচ চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা মডেল মসজিদের ইমাম শেখ হাসিনার পক্ষে প্রকাশ্যে ভোট চাইলেও এখনও বহাল আছেন পদে। এতে প্রশ্ন উঠেছে— সরকারি ইমামদের রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা ও প্রশাসনের আচরণ নিয়ে।
২০২৩ সালের ১৫ আগস্ট ফজরের নামাজ শেষে দোয়া করেন ইমাম ইলিয়াছ। দোয়ায় সাঈদীর নাম উচ্চারণ করায় উপজেলা প্রশাসনের রোষে পড়েন তিনি। কয়েকদিন পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাজিয়া সিদ্দিকা সেতু তাকে অফিসে ডেকে সতর্ক করেন। এরপর কোনো নোটিশ ছাড়াই ২৪ সেপ্টেম্বর তাকে ইমামতির দায়িত্ব থেকে মৌখিকভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ২৭ সেপ্টেম্বর তার হাতে দেওয়া হয় লিখিত অব্যাহতিপত্র।
অন্যদিকে একই দিনে, ১৫ আগস্ট, দামুড়হুদা মডেল মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা মামুনুর রশীদ এক দোয়া মাহফিলে বক্তব্য রাখেন। সেখানে তিনি শেখ হাসিনার সরকারকে “ইসলামের সরকার” বলে উল্লেখ করেন। এ সরকারের পক্ষে ভোট দিতে মুসল্লিদের আহ্বান জানান। এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এ ঘটনায় স্থানীয় আলেম সমাজ ও সাধারণ মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের অভিযোগ, একদিকে সাঈদীর জন্য দোয়া করায় বরখাস্ত, অন্যদিকে শেখ হাসিনার পক্ষে ভোট চাইলেও বহাল—এটা দ্বৈত নীতি ও পক্ষপাতের প্রকাশ।
বরখাস্ত ইমাম ইলিয়াছ হোসেন জানান, তিনি শুধু মৃতদের জন্য সাধারণ দোয়া করছিলেন। তাতে সাঈদীর নাম উল্লেখ করায় তাকে বরখাস্ত করা হয়। তিনি ইউএনওর কাছে আবেদন করলেও কোনো সহায়তা পাননি। পরে হাইকোর্টে রিট করেন। এখনো রায়ের অপেক্ষায় আছেন।
বর্তমান ইউএনও প্রীতম সাহা জানান, বিষয়টি বিচারাধীন। তাই কোনো মন্তব্য করতে চান না। তিনি আরও বলেন, ইলিয়াছকে বরখাস্তের সময় তিনি দায়িত্বে ছিলেন না।
অন্যদিকে মামুনুর রশীদের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, মামলা দিয়ে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। একদল আলেম দামুড়হুদা থানায় লিখিত অভিযোগও দেন। বাদী মাওলানা আব্দুল আউয়াল জানান, তার কাছ থেকে মামলার ভয় দেখিয়ে ৫০ হাজার টাকা আদায় করা হয়। পরে তাকে জোর করে ইমামের কাছে ক্ষমা চাইতেও বাধ্য করা হয়।
এই বিষয়ে দামুড়হুদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তিথি মিত্র জানান, তিনি সম্প্রতি দায়িত্বে এসেছেন। এখন পর্যন্ত কোনো লিখিত অভিযোগ পাননি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলামও জানান, তিনি নতুন যোগ দিয়েছেন। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন। অভিযোগ পেলে বিবেচনা করবেন।
চুয়াডাঙ্গা জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির এডভোকেট রুহুল আমিন বলেন, ফ্যাসিস্ট শাসনের সময় যারা অন্যায়ের শিকার হয়েছেন, তাদের প্রাপ্য অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া এখন সময়ের দাবি। তিনি বরখাস্ত ইমামকে তার পদে পুনর্বহালের দাবি জানান। একই সঙ্গে ভোট চাওয়া ইমামকে বরখাস্তের আহ্বান জানান।
চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শরিফুজ্জামান শরিফ বলেন, সরকারি পদে থেকে কেউ দলীয় বক্তব্য দিতে পারেন না। তিনি মামুনুর রশীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা চেয়েছেন।
চুয়াডাঙ্গা জেলা ওলামা দলের যুগ্ম আহ্বায়ক হাফেজ মাহবুবুল আলম বলেন, ভিডিও প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, তা বোধগম্য নয়। তিনি দ্রুত প্রশাসনের হস্তক্ষেপ দাবি করেন।
বাংলাদেশ সরকার কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর ৫ নম্বর বিধিতে বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন না বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারেন না। নির্বাচন কমিশনের বিধানেও সরকারি কর্মচারীদের রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বাধ্যতামূলক।
এসব আইন থাকা সত্ত্বেও এক ইমামকে শুধুমাত্র দোয়া করায় বরখাস্ত করা হয়েছে, অন্যদিকে আরেকজন প্রকাশ্যে ভোট চেয়ে বহাল থাকায় বিষয়টি নিয়ে সচেতন মহলে দ্বৈতনীতির অভিযোগ উঠেছে।