প্রতিষ্ঠার ১৪ বছর পেরিয়ে গেলেও নানা সংকট থেকে মুক্ত হতে পারেনি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি)। এই সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন পাঁচজন উপাচার্য (ভিসি), যাদের মধ্যে তিনজনকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সরে যেতে হয়েছে।
উপাচার্য পরিবর্তন হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের নানাবিধ সমস্যার তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি শ্রেণিকক্ষ, গবেষণাগার, আবাসন কিংবা প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক।
নেই পর্যাপ্ত একাডেমিক ভবন ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক সংকটের কারণে অধিকাংশ বিভাগেই সেশনজট স্থায়ী আকার নিচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে প্রায় ১১ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে রয়েছে মাত্র দুটি একাডেমিক ভবন। ছেলেদের ও মেয়েদের জন্য দুটি করে আবাসিক হল থাকলেও মাত্র ২৩ শতাংশ শিক্ষার্থী আবাসনের সুযোগ পাচ্ছেন। ২৫টি বিভাগের জন্য রয়েছে মাত্র ৩৬টি শ্রেণিকক্ষ, ফলে এক ব্যাচ ক্লাসে থাকলে অন্য ব্যাচগুলোকে বাইরে অপেক্ষা করতে হয়। বর্তমানে ১৬৭ জন শিক্ষক দিয়ে প্রায় ১৫০টি ব্যাচে পাঠদান পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে অনেকে আবার শিক্ষা ছুটিতে থাকায় শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে। শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের জন্য পর্যাপ্ত অফিসকক্ষ নেই, নেই অডিটোরিয়াম, মানসম্মত গবেষণাগার কিংবা আধুনিক গ্রন্থাগার। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা দিন দিন বাড়ছে।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব সংকটের পেছনে অন্যতম কারণ শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। তাদের মতে, অধিকাংশ আন্দোলনের পেছনে ছিল ব্যক্তিগত স্বার্থ ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। শিক্ষক মহলের একটি অংশ নিজেদের স্বার্থে শিক্ষার্থীদের উসকে দিয়ে আন্দোলন করান এবং পরে পদ-পদবি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অস্থিরতা ও আন্দোলনের ধারা যেন কখনোই থামেনি। সর্বশেষ ৫ম উপাচার্য অধ্যাপক শুচিতা শরমিনকে শিক্ষার্থীদের ২৯ দিনের টানা আন্দোলনের মুখে অপসারণ করে সরকার। তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী উপাচার্য। এর আগে ৩য় ভিসি মো. ছাদেকুল আরেফিনের আমলেও শিক্ষক-কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্ব থেকে কয়েকবার শিক্ষার্থীদের আন্দোলন হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মো. হারুনর রশিদ খান এবং ছাদেকুল আরেফিনই কেবল পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পেরেছিলেন। ৪র্থ উপাচার্য মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া ছয় মাসের মাথায় জুলাই আন্দোলনের ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগী আখ্যা পেয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন। সবচেয়ে বেশি আন্দোলনের মুখোমুখি হন ২য় উপাচার্য এস এম ইমামুল হক, যার বিরুদ্ধে দুই দফায় আন্দোলন হয়। একবার ১৫ দিন এবং পরেরবার টানা ৪৪ দিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ বলেন, আমরা চার সেমিস্টারে চার জন ভিসি দেখতেছি। চারজনের মধ্যে দুইজনের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। আমি মনে করি, তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনগুলো খুবই যৌক্তিক ছিল। যদিও ভিসিবিরোধী আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ হয়েছিল এবং অ্যাকাডেমিক শাটডাউন ঘটেছিল; যা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করেছে। এইভাবে যদি বারবার ভিসি পরিবর্তন হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে।
লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী মোকাব্বেল শেখ বলেন, গুটিকয়েক শিক্ষকের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণেই আজ বিশ্ববিদ্যালয় এমন অবস্থায় পৌঁছেছে। তারা বিভিন্ন নিয়োগ ও প্রশাসনিক তথ্য রাজনৈতিক নেতাদের কাছে সরবরাহ করে নিজেদের জন্য পদ-পদবি নিশ্চিত করেন। ক্যাম্পাসে শিক্ষক মহলে প্রভাব বিস্তার করে তারা অস্থিরতা তৈরি করছেন, যার ফলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ দিন দিন নাজুক হয়ে পড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বদলে এটি এখন রাজনৈতিক কার্যালয়ে পরিণত হয়েছে।
সর্বশেষ ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক সুজয় শুভ বলেন, চিন্তাভাবনা এবং পরিবেশের দিক থেকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এখনও একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়নি। মূল চ্যালেঞ্জ হলো অপর্যাপ্ত অবকাঠামো। বিগত উপাচার্যরা এসব সমস্যা সমাধানে আন্তরিক ছিলেন না। বরং বারবার অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও রাজনীতির ফাঁদে পড়ে তারা পথভ্রষ্ট হয়েছেন।
পরিসংখ্যান বিভাগের চেয়ারম্যান আহসানুল হক বলেন, আমরা মাত্র দুইজন শিক্ষক ৬-৭টি ব্যাচের ক্লাস চালাচ্ছি। প্রত্যেককে ১৮-২০টি কোর্স পড়াতে হয়। এই চাপ আমাদের ব্যক্তিগত জীবন ও ক্যারিয়ারে প্রভাব ফেলছে। তবুও চেষ্টা করছি যেন সেশনজট না হয়।
জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. হাফিজ আশরাফুল হক বলেন, শিক্ষকরা নিজেদের পদ পদবির জন্য দুটি গ্রুপে ভাগ হয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামেন। তাদের একটি অংশ বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ বাগিয়ে নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে মাফিয়াতন্ত্র কায়েম করতে চায়। কোনও ভিসি যদি একটি পক্ষের ঘনিষ্ঠ হন, তখনই অন্য পক্ষ তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ফলে বারবার সৃষ্টি হয় অস্থিরতা। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়। যতদিন এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ না হবে, ততদিন প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়।
নবনিযুক্ত (অন্তর্বর্তীকালীন) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌফিক আলম বলেন, শিক্ষার্থীরাই আমাদের মূল শক্তি। আমি সবসময় শিক্ষার্থীবান্ধব মনোভাব নিয়ে কাজ করি এবং আগামীতেও সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যেতে চাই। আমার বিশ্বাস, আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে কোনও সমস্যাই সমস্যা থাকে না। একটু বুদ্ধি ও সদিচ্ছা থাকলেই সমাধান বেরিয়ে আসে।