ঝালকাঠির ১০০ শয্যাবিশিষ্ট একমাত্র সদর হাসপাতালটি প্রতিদিন গড়ে ৮০০ রোগীর চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকে। জেলার বিভিন্ন উপজেলার মানুষ এই হাসপাতালেই চিকিৎসার জন্য আসেন। তবে নানা অনিয়ম, দালালচক্রের সক্রিয়তা এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তার কারণে সেবার পরিবর্তে ভোগান্তিই যেন হয়ে উঠেছে নিত্যদিনের চিত্র।
হাসপাতালটি এখন যেন দালালদের এক অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা বলছেন, তারা ভয়ানক এক দালাল সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের মুখে পড়ছেন, যারা বিভিন্ন প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছে। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কমপক্ষে ৫০ জনের বেশি দালাল হাসপাতালের অভ্যন্তর ও আশপাশে ঘোরাফেরা করে। এদের প্রধান টার্গেট দূর-দূরান্ত থেকে আসা সাধারণ রোগীরা।
এই দালালচক্র রোগী ও তাদের স্বজনদের বিভ্রান্ত করে, কৌশলে হাতিয়ে নেয় ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র এবং তারপর চাপ সৃষ্টি করে নির্দিষ্ট বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে। ফলে সরকারি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও রোগীদের গুণতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। শুধু তাই নয়, ভুল রিপোর্ট দেওয়ার ঘটনাও কম নয় বলে অভিযোগ করছেন রোগীরা।
পূর্ব চাঁদকাঠির বাসিন্দা হাসিবুল ইসলাম অনিক বলেন,’ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হতেই দেখি এক লোক এসে আমার ব্যবস্থাপত্র টেনে নিলো। বললো, ‘ভাই বাইরে ভালো রিপোর্ট হয়, আমরা নিয়ে যাব।’ পরে দেখি তারা জোর করে একটা নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিকে নিয়ে যাচ্ছিলো।’
অসংখ্য রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ, হাসপাতালের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক জানান,’প্রতিটা রিপোর্টের ৩০% ডাক্তারকে দিতে হয় কমিশন হিসেবে। যদি এই টাকা না দিতাম তাহলে আরো কম খরচে পরীক্ষা করাতে পারতাম।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, ‘ঝালকাঠি প্রাইভেট হসপিটাল অ্যান্ড ক্লিনিকি ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি নিজেই নিয়মিতভাবে হাসপাতালে অবস্থান করেন এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে দালালদের সংগঠিত রাখেন। বিভিন্ন সূত্র বলছে, তিনিই পুরো দালাল নেটওয়ার্কটি পরিচালনা করেন।
সরেজমিনে গেলে গণমাধ্যম কর্মীদের ক্যামেরা দেখে একাধিক দালাল দৌড়ে পালাতে শুরু করেন। কেউ দেয়ালের আড়ালে মুখ লুকান, কেউ আবার রোগীর ছদ্মবেশে টিকিট কেটে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করেন। এমনকি শটকে পড়েন ওই সভাপতি নিজেও।
সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) ঝালকাঠির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সত্যবান সেন গুপ্ত বলেন,’হাসপাতাল থেকে দালাল নির্মূল না করলে সাধারণ মানুষ কখনোই সঠিক সেবা পাবে না। দালালদের পেছনে হাসপাতালের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশ আছে বলেই তারা এতটা বেপরোয়া।’
এইসব অভিযোগের পরেও এই বিষয়ে ঝালকাঠি সিভিল সার্জন ও সদর হাসপাতালের অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর বলেন,’আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই দালাল নির্মূলে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করছি। অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা গেছে। হাসপাতালের প্যাথলজিতেও পরীক্ষার সংখ্যা বেড়েছে, রোগীও বেড়েছে।’
তিনি আরও জানান,’জেলাও প্রশাসকের সঙ্গে মাসিক আইন শৃঙ্খলা মিটিং এ ও হাসপাতাল চত্বরকে দালালমুক্ত রাখতে আলোচনা করা হয়েছে। প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। কেউ হয়রানির শিকার হলে লিখিত অভিযোগ করতে অনুরোধ করছি।’