আলমগীর: লাল ইট তৈরি হয় আগুনে, কিন্তু মানিকগঞ্জে কিছু ইটভাটা যেন জ্বলে উঠে অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রে। রাস্তাঘাটে গড়িয়ে পড়া ধুলার মতোই, এখানকার ইটভাটা বাস্তবতাও ঘোলাটে।
কাগজে-কলমে অভিযানের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে, জরিমানা জমছে সরকারি কোষাগারে—কিন্তু হিসাব মিলছে না একটি প্রশ্নে: কেন বারবার কিছু নির্দিষ্ট ভাটাই বারুদ হয়ে উঠে, আর বাকিগুলো যেন ‘ডিপ্লোম্যাটিক ইমিউনিটি’ নিয়ে টিকে থাকে?
সদরের একতা, এমিকা, আর সিংগাইরের রাকমান—পরিবেশ অধিদপ্তরের চোখে তারা অপরাধী। অভিযান, ভাঙচুর, আগুন নিভানো—সবই চলছে । কিন্তু মানিকগঞ্জবাসীর চোখে অপরাধের তালিকায় আছে গোলযোগ। কিছু ভাটা ছুঁলেই ঝড় ওঠে, কিছু ভাটাকে যেন ছোঁয়াও যায় না।
সফুর ব্রিকস আর রাকমান ব্রিকসের নাম যেন প্রতিটি অভিযানের সিগনেচার। এক মাসে চারবার অভিযান—পরের মাসে আবার। কিন্তু কুদ্দুসের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভাটাগুলোতে কেন অভিযান হচ্ছে না? নামও আসে না, গন্ধও না। অথচ ওইসব ভাটাই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা, বাড়ির পাশে গায়ে-গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে।
মানিকগঞ্জের অঘোষিত ‘ইট মাফিয়া চক্র’
যেখানে নিয়ম আছে, সেখানে থাকে নিয়ম ভাঙার কাঠামোও। এই কাঠামোরই নাম স্থানীয়রা রেখেছে—সিন্ডিকেট।
খোলাপাড়ার ‘অফিস ঘর’ থেকে চালানো হয় এই ইট সাম্রাজ্য। সভাপতি ইলিয়াস, সেক্রেটারি কুদ্দুস, ক্যাশিয়ার মোয়াজ্জেম—এই ত্রয়ীর বাইরে ভাটা মালিকরা যেন করজোড়ে বসে থাকেন, প্রতি মৌসুমে দেড় লাখ টাকা চাঁদা গুনে দিতে হয়। আর না দিলে? মামলা, অভিযান, থানা-পুলিশের যন্ত্রণা।
সবচেয়ে বিস্ময়ের জায়গা—এই সিন্ডিকেটের ছায়া পড়ে রাজধানীতেও। শরীফ মল্লিক, রুমি, জাফর ইকবাল, শামীম—এরা নির্ধারণ করেন, কোন ভাটা কবে ‘বলি’ হবে।
আইনের পর্দা, নিষ্ক্রিয় প্রশাসন: সবাই জানে, কেউ কিছু বলে না
একটি বাস্তবতা সকলেই জানেন: অধিকাংশ ইটভাটা আইন ভেঙে নির্মিত। দূরত্ব মানে না, পরিবেশ ভাবেনা। কিন্তু সেই আইন প্রয়োগ হয় বেছে-বেছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নে পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট উইং-এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফয়জুন্নেছা আক্তার কেবল ‘কৌশলী নীরবতা’ বেছে নেন। যেন সে নিজেও জানেন—সত্যটা বলা মানেই বদলির নোটিশ হাতে পাওয়া।
ভাটা নয়, প্রতিশোধের মঞ্চ: মালিকদের ভাষ্যে উন্মোচিত ভয়ঙ্কর চিত্র
রাকমান ব্রিকসের মালিক মিজানুর রহমান, আর সফুর ব্রিকসের মালিক আ: জলিল সরাসরি অভিযোগ করেছেন:
“এই অভিযান পরিকল্পিত। শরীফ মল্লিক নিজেই ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়িতে চড়ে এসে লোকেশন দেখিয়ে গেছে।”যদি তাই হয়, তাহলে প্রশ্ন জাগে? চাদাবাজ সিন্ডিকেট কিভাবে ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়িতে চড়ে আসে? আর কিভাবে প্রতিপক্ষের ভাটাগুলো দেখিয়ে দিয়ে ভাঙচুর আর জরিমানা করেন?
রাকমান ব্রিকসের মালিক মিজানুর রহমান, আর সফুর ব্রিকসের মালিক আ: জলিল সরাসরি অভিযোগ করেছেন, কুদ্দুস-ইলিয়াসরা চাঁদা আদায়ের নতুন কৌশল হিসেবে ‘প্রশাসনিক অভিযান’ ব্যবহার করছে। ভাটার আগুন নিভিয়ে আসলে তারা জ্বালিয়ে দিচ্ছে প্রতিপক্ষকে।
একটি ভিন্ন মানিকগঞ্জের স্বপ্ন—যেখানে ইটের চেয়ে ন্যায়বিচার শক্ত
মানিকগঞ্জ এখন একটা বাঁকে দাঁড়িয়ে। একদিকে ভাঙা চিমনি, অন্যদিকে গড়ে ওঠা সাহস। স্থানীয়রা চাইছেন, ‘লাল ইটের রাজনীতি’ থেকে মুক্তি। যেখানে চাঁদা দিয়ে নয়, নীতিমালায় টিকে থাকবে ব্যবসা। আর প্রশাসনের কাজ হবে চেহারা দেখে অভিযান নয়, আইন দেখে পদক্ষেপ নেওয়া।