শনিবার, ১৯ জুলাই, ২০২৫

রক্তাক্ত ১৮ জুলাই, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিরোধের এক উত্তাল দিন

এনামুল হোসেন, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
-বিজ্ঞাপণ-spot_img

১৮ জুলাই, ২০২৪। আন্দোলনে উত্তাল পুরো দেশ। পুলিশ ও ছাত্রলীগ অনবরত হামলা চালায় শিক্ষার্থীদের ওপর। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে গড়ে ওঠে ইস্পাতকঠিন প্রতিরোধ।

এইদিন এক ভিন্ন দৃশ্যপট তৈরি করেছিল বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সকালের আলো পুরোপুরি দৃশ্যমান হওয়ার আগেই শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে ক্যাম্পাসের চারপাশ ঘিরে ফেলে পুলিশ, র‍্যাব, এপিবিএন ও বিজিবির যৌথ বাহিনী। এ যেন এক নির্মম কারাগার। টহল ও অস্ত্রের ঝনঝনানিতে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। অসহায় শিক্ষার্থীরা। ঠিক তখনই নাটকীয় মোড়ে রূপ নেয় পুরো দৃশ্যপট। নির্ভীক একদল যোদ্ধা গড়ে তোলে প্রতিরোধ, যারা মৃত্যুকে পরোয়া করে না। সকাল থেকে যেই আতঙ্কের সূচনা করেছিল রাষ্ট্রীয় বাহিনী- বন্দুক, বুলেট বোমায়। আন্দোলন দমানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা। এর বিপরীতে প্রতিরোধের এক অনঢ় অবস্থান দেখায় শিক্ষার্থীরা।

এইদিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে প্রশাসনিক ভবনের নিচে জড়ো হতে থাকে শিক্ষার্থীরা। বেলা ১১টার দিকে ক্যাম্পাস থেকে মহাসড়কে বের হতে গেলেই পুলিশ শুরু করে হামলা। নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের বিপরীতে অস্ত্র নিয়ে হামলে পড়ে পুলিশ। চলতে থাকে সংঘর্ষ, টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছুড়তে থাকে যৌথবাহিনী। আহত হয় একে একে অর্ধ-শতাধিক শিক্ষার্থী, তখনই আবার প্রতিরোধ গড়ে ওঠে, বুলেটের জবাবে শিক্ষার্থীরাবৃষ্টির মতো ছুড়তে থাকে ইট-পাটকেল। লাঠিসোঁটা হাতে নিয়ে অবরোধ করেন ঢাকা-কুয়াকাটা ও বরিশাল-ভোলা মহাসড়ক। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের মাইকে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে এক ঘোষণা আসে-আমরা আপনাদের সন্তান, আমাদের পাশে আসুন। স্থানীয় জনতা তখন শিক্ষার্থীদের ডাকে নেমে পড়ে। ধীরে ধীরে রাজপথের পরিপূর্ণ দখল নিতে থাকে শিক্ষার্থীরা। পিছু হটতে থাকে যৌথবাহিনী।

শিক্ষার্থীরা যখন দখলে নেয় মহাসড়ক, তখন বরিশালের খয়রাবাদ সেতুর প্রান্তে আটকে পড়ে পুলিশ,র‍্যাব, এপিবিএন সদস্যরা। তারা বরিশাল নগরমুখী হতে চাইলে শিক্ষার্থীরা রুখে দাঁড়ায়। এক পর্যায়ে যৌথবাহিনী নত শিক্ষার্থীদের সামনে। স্বীকার করে নেয় তাদের অপরাধ, চায় নিঃশর্ত ক্ষমা। শিক্ষার্থীরা তখন ব্যারিকেড দিয়ে তাদের দপদপিয়া সেতু পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের নির্মম আচরণের জন্য তৎকালীন উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই দায়ী করেন।

এই দিনটা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গিয়ে আহত অর্ধ-শতাধিক শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়েছিল শেরে-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দিতে ছুটে আসে বরিশালের সাউথ অ্যাপোলো মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা।

সেইদিনটায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা, খাবারের দোকান ছিল বন্ধ, দুপুরে কোথাও খাবার নেই। তখনই রান্না করা খাবার নিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ান আত্মার আত্মীয়রা।

বরিশালে প্রতিরোধের সেই রক্তাক্ত স্মৃতি নিয়ে রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী ও ববি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহবায়ক রাকিব আহমেদ বলেন, সকাল থেকে ক্যাম্পাস ঘিরে ফেলে যৌথবাহিনী, আমরা গেট ভেঙে সড়কে নেমে আসি। ওরা গুলি চালায়, টিয়ারশেল ছোঁড়ে। কিন্তু আমাদের তখন বসে থাকার মতো অবস্থা ছিল না। স্থানীয় জনতাকে নিয়ে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলি। র‍্যাব, পুলিশ, বিজিবি, এপিবিএন- সবাই একপর্যায়ে পরাস্ত হয়, শিক্ষার্থীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে ক্যাম্পাস ছাড়ে। সেদিন আমরা শুধু প্রতিরোধ করিনি, আমরা লিখেছি এক প্রতিরোধের ইতিহাস।

আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক সুজয় বিশ্বাস শুভ সেই স্মৃতিচারণ করে বলেন, ১৭ তারিখ রাত থেকে ক্যাম্পাসের আশপাশের এলাকায় কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করছিলাম। ১৮ তারিখ সকালে ঘুম ভাঙতেই ফেসবুক খুলে দেখি ক্যাম্পাস ঘিরে ফেলেছে যৌথ বাহিনী। রাস্তাঘাট অবরুদ্ধ। সড়কপথে ক্যাম্পাসে যাওয়ার উপায় ছিল না। সিদ্ধান্ত নিলাম নদীপথে ক্যাম্পাসে ফিরব। কাঁঠালতলায় সবাই জড়ো হয়ে রওনা হলাম। নদীর ঘাটে পৌঁছে দেখি, কোনো নৌযান নেই। একমাত্র ভরসা একটি কার্গো ট্রলার, যা পণ্য তুলছিল। মালিক লোকসানের ভয়ে নিতে চাইলেন না। তখন শ্রমিকরা বললেন, আমরা আমাদের মজুরি ছেড়ে দেব, তবুও চলেন আমরা আপনাদের পৌঁছাই।’

‘কী অসম্ভব আত্মত্যাগ! আমাদের শ্রমিক ভাইয়েরা যে সেদিন শুধু আমাদের না, ইতিহাসকে বয়ে নিয়েছিলেন ক্যাম্পাসে। নদী পার হয়ে গ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা হেঁটে পেছন দিক দিয়ে গোপনে ক্যাম্পাসে ঢুকি। অপেক্ষারত ভাই-বোনদের সঙ্গে মিলিত হই, তালাবদ্ধ গেট ভেঙে সড়কে নেমে পড়ি রাজপথে। তখনই শুরু হয় যৌথ বাহিনীর অতর্কিত হামলা, প্রতিবাদে পাল্টা আক্রমণ করে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীরাও, তৈরি হয় রণক্ষেত্রে’, যোগ করেন তিনি।

সুজয় শুভ জানান, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যৌথবাহিনীর সংঘর্ষ শুরু হয়। এক পাশে ইট, ডালপালা, স্লোগান স্লোগানে কেঁপে ওঠে রাজপথ। আর অন্য পাশে চলতে সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল, রাবার বুলেট আর ছররা গুলি। রক্তাক্ত হয় শিক্ষার্থীদের শরীর, কিন্তু চূর্ণ হয় না তাদের মনোবল। সংঘর্ষ চলে টানা আড়াই ঘণ্টা।

পুলিশের গুলিতে সেইদিন বিল্লাল নামের একজন স্থানীয় অটোরিকশাচালক চিরদিনের জন্য অন্ধত্ব বরণ করেন। অনেকে গুরুতর আহত হন। তবু লড়াই থামেনি। ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রতিরোধে পিছু হটে রাষ্ট্রীয় চার বাহিনী। তারা বলতে বাধ্য হন- আমরা আর হামলা করবো না, এমন শর্তে আত্মসমর্পণ করে ক্ষমা চেয়ে শহরের দিকে চলে যায়। শুভ জানান, আমরা তাদের গার্ড দিয়ে দপদপিয়া সেতু পার করে দিই, এটাই ছিল বর্বরতার মুখে আমাদের সভ্য প্রতিশোধ।

সেই দৃশ্য মুহূর্তেই সেইদিন ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়, গণমাধ্যমে। দেশের মানুষ দেখে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সেদিন মাথানত করেনি।

জুলাইয়ের প্রথম স্বাধীন ক্যাম্পাস হিসেবে পরিচিত পায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। সেদিন পুরুষ-নারী সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। নারীরা ছিল প্রতিরোধের অগ্রভাগে। লড়াইয়ে, আহতদের সেবা-শুশ্রূষায় তাদের ভূমিকাও ছিল অতুলনীয়। আনোলনে নেমে আহত হয়েছিলেন নারী শিক্ষার্থীরা। সেদিন রক্তাক্ত হয়ে লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। তবু কেউ পিছু হটেননি। হাল ছাড়েননি।

স্থানীয়দের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সুজয় বিশ্বাস শুভ বলেন, ‘কর্ণকাঠির মা-বোনেরা নিজের হাতে রান্না করা খাবার এনে আমাদের খাইয়েছেন। নিজের সন্তান ভেবে আমাদের যত্ন করেছেন। এই মায়া আমরা কোথায় পাব? তারা আমাদের রক্তের আত্মীয় না হলেও আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠেছিলেন সে দিন। তাদের এই অবদান আমরা কখনো ভুলব না।’

সেদিনের সংঘর্ষে শরীরে ৫০টির অধিক গুলি নিয়ে বেঁচে ফেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হাসনাত আবুল আলা বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে আগ্নেয়াস্ত্র আর আমাদের হাতে ছিল শুধু লাঠি আর ইট, ছিল অসীম সাহস আর প্রতিবাদী হিম্মত। তারা ভেবেছিল আমাদের অস্ত্র দিয়ে দমন করবে, কিন্তু আমরাই তাদের নতজানু করে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য করি।’

বরিশাল গড়েছিল এক প্রতিরোধের ইতিহাস। ইস্পাত কঠিন প্রতিরোধে নতজানু করেছিল স্বৈরাচার সরকারের বাহিনী।

শেয়ার করুন

সর্বশেষ নিউজ

জামায়াতকে ৪ জোড়া ট্রেন বরাদ্দ, যা বলছে রেল কর্তৃপক্ষ

রাজধানীতে মহাসমাবেশে নেতাকর্মীদের আনা-নেয়ার জন্য জামায়াতে ইসলামকে চার জোড়া ট্রেন বরাদ্দ দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।শুক্রবার (১৮ জুলাই) রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা রেজাউল করিম সিদ্দিকীর...

গোপালগঞ্জে যৌথ বাহিনীর অভিযানে আটক ৪৫

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রাকে ও সমাবেশকে কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জ সহিংসতার ঘটনায় যৌথ বাহিনীর অভিযানে শুক্রবার (১৮ জুলাই) সকাল পর্যন্ত মোট ৪৫ জনকে আটক...

ফেরিঘাটের ইজারা নিয়ে ছাত্রদল-যুবদলের দ্বন্দ্বে বন্ধ ফেরী চলাচল, যান চলাচলে দুর্ভোগ

শরীয়তপুরে ঘাটের ইজারা নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়েছে বিএনপির দুটি পক্ষ। জেলার ভেদরগঞ্জে-নরসিংহপুর ঘাটের ইজারা নিয়ে চলমান দ্বন্দ্বের জেরে বন্ধ রয়েছে ফেরি চলাচল।শুক্রবার (১৮ জুলাই) সকাল...

নারায়ণগঞ্জে এনসিপির আগমনে নির্মিত গেইটে আগুন

সারাদেশের ধারবাহিকভাবে জুলাই পদযাত্রা করে যাচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টি(এনসিপি)। এ পদযাত্রার অংশ হিসেবে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতাদের আগমনকে ঘিরে নারায়ণগঞ্জে নির্মিত একটি তোরণে আগুন দিয়েছে...

সম্পর্কিত নিউজ

জামায়াতকে ৪ জোড়া ট্রেন বরাদ্দ, যা বলছে রেল কর্তৃপক্ষ

রাজধানীতে মহাসমাবেশে নেতাকর্মীদের আনা-নেয়ার জন্য জামায়াতে ইসলামকে চার জোড়া ট্রেন বরাদ্দ দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে...

গোপালগঞ্জে যৌথ বাহিনীর অভিযানে আটক ৪৫

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রাকে ও সমাবেশকে কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জ সহিংসতার ঘটনায় যৌথ বাহিনীর...

ফেরিঘাটের ইজারা নিয়ে ছাত্রদল-যুবদলের দ্বন্দ্বে বন্ধ ফেরী চলাচল, যান চলাচলে দুর্ভোগ

শরীয়তপুরে ঘাটের ইজারা নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়েছে বিএনপির দুটি পক্ষ। জেলার ভেদরগঞ্জে-নরসিংহপুর ঘাটের ইজারা নিয়ে...