শনিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৫

মাওলানা দেলওয়ার হোসাইন সাঈদী: সাধারণ নাগরিকের দৃষ্টিতে তিনি কেমন মানুষ ছিলেন

মোহাম্মদ সালেক
-বিজ্ঞাপণ-spot_img

২০২৩ সালের ১৪ই আগস্ট। মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী (রঃ) ইন্তেকাল করেছিলেন। আমি ইচ্ছা করেই কোন বিশেষণ ব্যবহার করলাম না। কারণ, তিনি ছিলেন সাধারণভাবে ব্যবহৃত বিশেষণের উপরে। নামেই পরিচয়, ঘটা করে বলার দরকার নেই, তিনি কী ছিলেন। তার মৃত্যুদিবস উপলক্ষে একটু স্মৃতিচারণ করছি। দল-মত নির্বিশেষে সাধারণ লোকেরা কেন ‘আল্লামা সাঈদী সাহেব(রঃ)র’ জন্য এত ‘ফিদা’ ছিল। আমি মনে করি বর্তমান এবং আগামি প্রজন্মের এই বিষয়টি ভালভাবে বুঝা দরকার।

অনেক ছোটবেলা থেকেই ওয়াজ শুনা আমার একটি প্রিয় শখ। প্রথম যাত্রা শুরু হয়েছিল বাবার হাত ধরে। পরবর্তীতে যখন একাই যাওয়া শুরু করলাম, লক্ষ্য করলাম যে, ওয়াজ মাফ্‌ফিলে যেতে বাবা-মা কিংবা অন্য কোন মুরুব্বীর পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা তো নেই-ই, বরঞ্চ উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। তাই ওয়াজ মাহফিলের নাম শুনলেই হাজির হতাম। এভাবে ওয়াজ শুনতে শুনতেই আমি খুব দ্রুত ধরে ফেললাম ওয়াজের এবং ওয়াজিদের প্যাটার্ন। কে কোন সিলসিলার, কার প্রিয় স্টাইল কি ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে প্রায় সকলের মধ্যে একটা ‘কমন’ বিষয় ছিল। ওয়াজের শুরুতে খুৎবা পড়তেন, তারপরে ২টা বা ৩টা আয়াত পড়তেন, ১টি হাদীস শুনাতেন । অতঃপর লম্বা সময় ওয়াজ করতেন। কিন্তু এই সুদীর্ঘ ওয়াজে না উচ্চারিত হত কুরআনের আর কোন আয়াত, না শুনানো হতো আর কোন হাদীস। কেবল বলা হত কিস্‌সা-কাহিনী, যার প্রায় প্রতিটিতে থাকত কোন বুজুর্গের কোন কারামতের বর্ণনা। তাই একটা সময় পর্যন্ত ওয়াজ বলতে বুঝতাম কিছু অত্যাশ্চর্য কিচ্ছা-কাহিনী। কেবল আমি একা নই, ঐ যুগে সর্বসাধারণ তাই ভাবত।

কিন্তু এই চিন্তা-চেতনায় সর্বপ্রথম বড় ধরণের ধাক্কা দিলেন আল্লামা দেলওয়ার হোসাইন সাঈদি সাহেব । আমি প্রথম তার ওয়াজ শুনি ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে, ৫-দিন ব্যাপী তাফসীর মাহফিলের ২য় দিনে, মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুলের মাঠে, চট্টগ্রামে। এক ক্লাসমেট অনেকটা জোড়-জবরদস্তি ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সত্যি মনটা ভরে গেল। নাকি সুরের জোর করে কান্না-কাটি নেই, নেই আজগুবি গল্পের বন্যা। বরং শুনলাম বিশুদ্ধ বাংলায় ভরাট কণ্ঠের বলিষ্ঠ বয়ান। সবচে মুগ্ধ হলাম সাঈদী সাহেবের কানজুড়ানো, প্রাণ-শীতলকারী তিলাওয়াত শুনে। বয়ানের ফাঁকে ফাঁকে তিনি এক মোহন সুরে তিলাওয়াত করতেন। যখন তিলাওয়াত করতেন, মনে মনে চাইতাম, তিনি যেন না থামেন। প্রায় মাহফিলে তিনি ২-৩ পৃষ্ঠা তিলাওয়াত শুনিয়ে দিতেন।

সে-ই শুরু ! কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-কর্মজীবন, জীবনের বাঁক বদলেছে বারংবার। কিন্তু না-বদলানো বিষয়গুলোর মধ্যে একটি ছিল সাঈদী সাহেবের ওয়াজ শুনা। যখন সুযোগ মিলেছে, তার মাহ্‌ফিলে হাজির থেকেছি। তখন বুঝিনি, কিন্তু আজ ১২ বৎসর ধরে উপলব্ধি করেছি আসলে আমরা মহাসৌভাগ্যবান ! সাঈদী সাহেবকে স্বচক্ষে দেখেছি, সরাসরি তার বয়ান শুনেছি। আর আল্লাহ্‌র শুকরিয়া, আমরা বিজ্ঞানের উন্নতির এমন এক যুগে বাস করছি যে উনার অনেক বয়ান রেকর্ডকৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। যা দিয়ে তৃষ্ণার্ত কিছুটা হলেও তৃষ্ণা মেটাতে পারবে।

কী এমন বৈশিষ্ট্য ছিল আল্লামার বয়ানে !

সবগুলো বলতে গেলে নিজে অসাধারণ হতে হবে। আমি তেমন কেহ নই। তবুও কিছু বলছি। যারা সাঈদী সাহেবকে পাননি, কেবল রেকর্ডকৃত বয়ান শুনেছেন, তারা যদি এই পয়েন্টগুলো মনে রাখেন, তবে সাঈদী সাহেবের অবদানকে সম্যক উপলব্ধি করতে পারবেন।

১.বিশ্বনবী(সা.) কুরআন তিলাওয়াত করে করে মানুষকে ইসলামের পথে আহবান করতেন। সাঈদী সাহেবও সেই পদ্ধতি অবলম্বন করতেন।
২. ইখতেলাফী মাসয়ালা তিনি একদম বলতেন না।

৩. শের/কবিতা এত কম বলতেন যে, বলার মত না। আমি সারাজীবনে উনাকে কেবল ইকবাল আর নজরুলের কয়েক লাইন পড়তে শুনেছি। অথচ উনার কণ্ঠস্বর এবং আবৃত্তি এত বেশী উন্নত মানের ছিল যে, উনাকে এ+ দিলে, যারা শে’র শুনিয়ে মানুষকে মোহিত করে তাদেরকে সর্বোচ্চ বি+ দেয়া যেতে পারে।
৪.মাহ্‌ফিলের মঞ্চকে কখনোই হাসি-তামাসার মঞ্চ বানাননি।

মানুষ আজো রেকর্ডকৃত সাঈদী সাহেবের ওয়াজ যেমন মনযোগের সাথে শুনে, আর কারোরটা তেমনিভাবে না। নিরপেক্ষতার সাথে বললে, সাঈদী সাহেব হলেন ওয়াজের জগতের মুকুটহীন সম্রাট। তাকে যদি ওয়াজের মুজাদ্দিদ বলা হয়, বিন্দুমাত্র অতিশয়োক্তি হবে না। উনার এই খিদমতটি প্রকাশ্য। ওয়াজের নামে কেবল কিসসা-কাহিনী (সত্য/মিথ্যা যাই হোক) শুনার মানসিকতা থেকে মানুষকে মুক্ত করে কুরআন-হাদীস এবং তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শুনার মন-মেজাজ তৈরি করতে তিনি সমর্থ হন।

কিন্তু সাঈদী সাহেবের নীরব খিদমতটি আরো বিস্ময়কর। পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা ছিল আমেরিকার সাথে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সুসম্পর্ক তৈরি হল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে। আর সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন স্বপ্ন দেখতো বিশ্বজুড়ে কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠা করার। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে লব্ধপ্রতিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে করোনা ভাইরাসের মত দ্রুত গতিতে কম্যুনিজমের মানসিকতা ছড়িয়ে পড়ছিল যুব সমাজের মধ্যে। আজ হতে প্রায় হাজার বছর আগে ইসলামী সমাজে প্লেগের ন্যায় ছড়িয়ে পড়া ‘গ্রীক দর্শন’-কে দাফন করার জন্য মহান আল্লাহ্‌ পাক ইমাম গাজ্জালী(র.)কে পাঠিয়েছিলেন । ঠিক তেমনি স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ হতে কম্যুনিজমের ভূত তাড়ানোর জন্য সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ্‌ পাক সাঈদি সাহেবকে পাঠালেন । প্রায় বয়ানে তিনি এসব বিষয়ে আলোকপাত করতেন। উনার মেহনত আল্লাহ্‌র দরবারে গৃহীত হল। কম্যুনিজমের এবং সমাজতন্ত্রের ভাইরাসটা আস্তে আস্তে মারা গেল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস কোনদিন এদেশে কেহ পিএইচ. ডি. অভিসন্দর্ভ লিখবে যার বিষয়বস্তু হবে সাঈদী সাহেবের ওয়াজ দ্বারা যুব সমাজ কিভাবে উপকৃত হয়েছিল।

আমি রাজনীতির সাথে কখনো সক্রিয়/সংযুক্ত ছিলাম না। সাঈদী সাহেব রাজনীতি করতেন। তাই রাজনৈতিক কর্মীরা যেভাবে সহজে উনার কাছে যেতে পারত, আমাদের ঐ সুযোগ ছিল না। আর আমার তেমন কোন আগ্রহও ছিল না। আমি উনার মাহ্‌ফিলে যেতাম আমার ফায়দার জন্য। সব মানুষ ফুলের ঘ্রাণ নেয়, কিন্তু ফুলের সাথে সম্পর্ক খুব কম মানুষই পাতায়। ব্যাপারটা অনেকটা তেমনি। তারপরেও ‘আকস্মিক’ বলে একটা কথা আছে। আল্লামা সাঈদীর সাথেও আমার ব্যক্তিগত একটি সুখস্মৃতি আছে। বড় স্বাদ হচ্ছে, সবাইকে সেটা জানাই।

১৯৮৮ (বা ’৮৯ সালের) কথা। ঢাকাস্থ মহাখালী কলেরা হাসপাতালের ধারে-কাছে সাঈদী সাহেবের মাহ্‌ফিল। উনার বক্তব্য শেষ। ঘোষণা দেয়া হল, সবাই ওযু করে রেডি হোন। ১০ মিনিট পর ঈশার জামাত হবে। লক্ষ্য করলাম, মঞ্চেও গুটিকয়েক লোকমাত্র, বাকিরা ওযু করতে গেছে। আরও দেখলাম, সাঈদী সাহেব মঞ্চে বসা। ‘এই সুযোগ’ ভেবে কাছে গিয়ে মুসাফা করলাম। তারপরে কী এক আবেগে হঠাৎ বলে ফেললাম, “ আমাদের অনেক লোকের শখ আপনার পেছনে নামায পড়া। ঈশার নামাযটা আপনি পড়ান।” উনি একটু হেসে বললেন, “তাই বুঝি!” কিন্তু আর কিছুই বললেন না। বিস্ময়ের এবং আনন্দের ব্যাপার এই যে, নিয়ত বাঁধার পর যখন তিলাওয়াত শুরু হল, বুঝলাম তিনিই নামায পড়াচ্ছেন। ১ম রাকাতে সূরা ত্বিন এবং ২য় রাকাতে সূরা লাহাব (সম্ভবতঃ) পড়েছিলেন, হদরের নিয়মে।

আর একটি ঘটনা। ১৯৮১ সাল। চট্টগ্রামের কদমতলী রেলক্রসিং এর কাছে সাঈদী সাহেবের মাহ্‌ফিল। রাত ৮ টার দিকে তিনি মাইক হাতে নিলেন। তিনি ‘নাহ্‌মাদুহু’ বলার আগেই শুরু হল প্রচণ্ড বাতাস, সব উড়িয়ে নিয়ে যায় যায় এমন অবস্থা! সাথে ফোটা ফোটা বৃষ্টিও পড়তে শুরু করল। লোকেরা দাঁড়িয়ে গেল, কে কোন দিকে দৌড়াবে, ভাবছে। এমন সময় মাইকে ভেসে এল সাঈদী সাহেবের ভরাট কণ্ঠস্বর, যেন ধ্যানমগ্ন কেহ কথা বলছেন, “একজনও নড়বেন না, সবাই মিলে দরূদ শরীফ পড়তে থাকুন, ইনশা-আল্লাহ্‌ বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যাবে।” এই বলেই তিনি নিজেই শুরু করলেন, “ আল্লাহুম্মা সাল্লে …”। সাথে সাথে সভার সব লোকেরাও বসে গেল এবং দরূদ শরীফ পড়তে লাগল। অনধিক ১০ মিনিট ! ঝড়ো বাতাস এবং বৃষ্টি, দুটোই বন্ধ। এবার আল্লামা বয়ান শুরু করলেন। প্রায় সাড়ে ১০টা পর্যন্ত বক্তব্য রাখলেন। সভা, নামায ইত্যাদি শেষে বাসার পথ ধরলাম। ততক্ষণে ১১টা বেজে গেছে। শুরু হল বৃষ্টি, মুষলধারে। এক্কেবারে গোসল হয়ে বাসায় ফিরতে হল।

পাঠক ! বিশ্বাস-অবিশ্বাস-নাক সিটকানো আপনার ব্যাপার, আমার নয়। আমার নিকট ঘটনাটি অতটুকু সত্য, যতটুকু সত্য সাঈদী সাহেব এখন মৃত।

মোহাম্মদ সালেক
লেখক, শিক্ষক, গবেষক

শেয়ার করুন

সর্বশেষ নিউজ

চাঁপাইনবাবগঞ্জে দুই মাদ্রাসা ছাত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু 

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে একটি মহিলা মাদ্রাসায় দুইজন আবাসিক  শিক্ষার্থীর রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।শনিবার (১৬ আগস্ট)  ভোরে উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের ডোবার মোড় এলাকার শেফালী বেগম মহিলা...

বর্তমান সংবিধানের অধীনে নির্বাচনে যাবে না এনসিপি: হান্নান মাসউদ

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ বলেছেন, বর্তমান সংবিধানের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনে এনসিপি অংশ নেবে না।শুক্রবার ( ১৫...

ট্রাম্প-পুতিনের বৈঠক ‘অত্যন্ত ইতিবাচক’ হয়েছে: ক্রেমলিন

আলাস্কায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠক ‘অত্যন্ত ইতিবাচক’ হয়েছে বলে জানিয়েছেন ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ। শনিবার (১৬ আগস্ট) রাশিয়ান সংবাদ...

দাবিকৃত চাঁদা না দেওয়ায় ব্যবসায়ীকে হত্যা ও মেয়েকে অপহরণের হুমকি, ছাত্রদল নেতাকে গ্রেফতার

দেবিদ্বার প্রতিনিধিকুমিল্লার দেবিদ্বারে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা নিতেন একজন ছাত্রদল নেতা। একপর্যায়ে দাবিকৃত চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ওই ব্যবসায়ীকে হত্যা এবং তার...

সম্পর্কিত নিউজ

চাঁপাইনবাবগঞ্জে দুই মাদ্রাসা ছাত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু 

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে একটি মহিলা মাদ্রাসায় দুইজন আবাসিক  শিক্ষার্থীর রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।শনিবার (১৬ আগস্ট) ...

বর্তমান সংবিধানের অধীনে নির্বাচনে যাবে না এনসিপি: হান্নান মাসউদ

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ বলেছেন, বর্তমান সংবিধানের...

ট্রাম্প-পুতিনের বৈঠক ‘অত্যন্ত ইতিবাচক’ হয়েছে: ক্রেমলিন

আলাস্কায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠক ‘অত্যন্ত ইতিবাচক’ হয়েছে...