শাহেনশাহ-ই-কাওয়ালি কিংবা কাওয়ালির সম্রাট বললে যাকে নিয়ে অত্যুক্তি করা হয় না, তিনি অমর সংগীতশিল্পী ওস্তাদ নুসরাত ফতেহ আলী খান। কাওয়ালীর জগতে যেন তুলেছেন এক নতুন আলোড়ন। এই ঘরনার পরিচয়ই সুরের জাদুতে আর শৈল্পিক নৈপুণ্যে বদলে দিয়েছেন।
শত শত বর্ষ ধরে চলে আসা সুফি বাণীগুলোকে নতুন প্রাণ দেওয়া থেকে শুরু করে বিশ্বব্যাপী তার শিল্পকে জনপ্রিয় করে তোলা— তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
উপমহাদেশের এই কিংবদন্তী সংগীতশিল্পীর গতকাল ছিল ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। এই শিল্পীর স্মরণে তার ১০টি কালজয়ী সৃষ্টির ইতিহাসে ঘুরে আসা যাক।
‘মস্ত মস্ত দম মস্ত’
প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ বছর আগে আমির খসরু লিখেছিলেন এই গানটি এমন কথাই লোকমুখে প্রচলিত আছে, যা পরে বুল্লে শাহ কর্তৃক অভিযোজিত হয়। রহস্যময় এই কাওয়ালিটি নূর জাহান, আবিদা পারভীন এবং জুনুন-এর মতো শিল্পীরা এর বিভিন্ন সংস্করণ গাইলেও, নুসরাত ফতেহ আলি খানের পরিবেশনায় এর মধ্যে এক অন্যরকম শান্তি খুঁজে পাওয়া যায়।
‘ইয়ে যো হালকা হালকা সুরুর’
আধ্যাত্মিক জ্ঞানলাভের অভিজ্ঞতাকে মাতাল হওয়ার অনুভূতির সাথে তুলনা করা হয়েছে এই কাওয়ালী গানে, এটিও নুসরাতের অন্যতম জনপ্রিয় একটি কাওয়ালি। যেখানে ভক্ত নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ঈশ্বরের সাধনায় মগ্ন হন।
‘কালি কালি জুলফোঁ কে ফান্দে না ডালো’
নুসরাতের সবচেয়ে জনপ্রিয় কাওয়ালিগুলোর মধ্যে হয়তো এটি শুরুর দিকে থাকবে। যে কোনো অনুষ্ঠানে এই গান পরিবেশিত হলে সেখানে এক ভিন্ন আবহ তৈরি হয়। অনেকেই এর সংস্করণ গাইলেও মূল গানটির ধারে কাছেও কেউ পৌঁছাতে পারেননি।
‘সোচতা হুঁ’
এই কাওয়ালিটি সময়ের সাথে হারিয়ে যাওয়া নির্দোষতা বা সারল্যের প্রতীক। অনলাইনে অনেক রিমিক্স হওয়ার কারণে এটি তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
‘সাঁসো কি মালা’
হিন্দু রহস্যবাদী কবি মীরা বাই ষোড়শ শতাব্দীতে এটি লিখেছেন। নুসরাত ১৯৮০ সালে তার প্রথম ভারত সফরে এই কাওয়ালিটি পরিবেশন করেন। আজও এটি ভারত ও বাংলাদেশের মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যে সমানভাবে জনপ্রিয়।
‘ইয়া গাউস ইয়া মীরান’
নুসরাতের সর্বশেষ অ্যালবাম ‘চেইন অফ লাইট’ থেকে নেওয়া একটি গান ইয়া গাউস ইয়া মীরান, যা গত বছর প্রকাশ পেয়েছে। অ্যালবামটি মূলত ৩৪ বছর আগে রেকর্ড করা কিছু হারিয়ে যাওয়া গানের সংকলন।
‘আজা তেনু আঁখিয়া উদিক দিয়া’
নুসরাতের চিরসবুজ পাঞ্জাবি গানগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এই গানটি তাকে তার জন্মস্থান জলন্ধর ও ফয়সালাবাদে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
‘মস্ত নজরোঁ সে আল্লাহ বাঁচায়ে’
আরেকটি জনপ্রিয় কাওয়ালি। এতে আকর্ষণীয় সৌন্দর্যের শক্তিকে স্বীকার করে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে, যেন সেই মোহে কেউ আকৃষ্ট না হয়। ‘কালি কালি জুলফোঁ’ এবং ‘সোচতা হুঁ’-এর মতোই এটিও তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয়।
‘মেরা পিয়া ঘর আয়া’
এটি বুল্লে শাহ-এর একটি উৎসবের কবিতা। এতে দীর্ঘ অপেক্ষার পর তার গুরু-এর সাথে পুনর্মিলনের কথা বলা হয়েছে। কোক স্টুডিওতে ফরিদ আইয়াজ ও আবু মুহাম্মদের পরিবেশনায় এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এটি নুসরাতের ১৯৭৭ সালের নিজস্ব সংস্করণ।
‘লংগিং’
সবশেষে, কানাডীয় গিটারিস্ট মাইকেল ব্রুকের সাথে নুসরাতের যৌথ অ্যালবাম ‘নাইট সং’ থেকে একটি গান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ‘তেরে বিন নহি লাগদা দিল মেরা’-এর এই সংস্করণটি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের একটি দারুণ ফিউশন এবং এটি অসাধারণভাবে অবহেলিত একটি গান।
নুসরাত ফতেহ আলী খান আজও তার কণ্ঠের যাদুতে কোটি কোটি ভক্তের হৃদয়ে বেঁচে আছেন। তার সংগীত শুধু একটি শিল্প নয়, বরং একটি আধ্যাত্মিক যাত্রা, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানে জন্ম নেওয়া এই মহান শিল্পী উপমহাদেশে সংগীতের জগতে এক ভিন্ন ধারার পরিচয় ঘটান। তার সময়ে তিনি শ্রেষ্ঠ সংগীত শিল্পী ছিলেন। ১৯৯৭ সালের ১৬ আগস্ট এই সুরের জাদুকরকে হারায় পৃথিবী।