নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (নোবিপ্রবি) শিক্ষকদের শিক্ষাছুটি অনুমোদনে নিয়ম-নীতিমালা মানা হচ্ছে না। শিক্ষক সংকটে এতে করে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা পড়েছেন চরম ভোগান্তিতে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) নীতিমালা অনুযায়ী একটি বিভাগের ২০-২৫ শতাংশ শিক্ষক শিক্ষাছুটিতে যেতে পারবেন। আর নোবিপ্রবির আইন অনুযায়ী পারবেন সর্বোচ্চ এক –তৃতীয়াংশ। কিন্তু এক্ষেত্রে ইউজিসি এবং বিশ্ববিদ্যালয়, কোনোটির তোয়াক্কা না করে নিয়ম বহির্ভূতভাবে শিক্ষকদের শিক্ষাছুটির অনুমোদন দেয়া হচ্ছে নোবিপ্রবিতে ।
তথ্যানুযায়ী, নোবিপ্রবির অন্তত পাঁচ বিভাগে ৫০ শতাংশেরও বেশি শিক্ষক ছুটিতে আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজী বিভাগে সবচেয়ে বেশি ১২ জন শিক্ষক শিক্ষা ছুটিতে রয়েছেন। যা ওই বিভাগের মোট শিক্ষকের ৫২.২ শতাংশ । এছাড়াও অর্থনীতি বিভাগে ১০ জন যা ৫২.৬৩, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগে ৭ জন যা ৫৩.৮৮, বাংলা বিভাগে ৭ জন যা ৫০ এবং ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি ৬ জন, যা ৪৬.১৫ শতাংশ শিক্ষক শিক্ষা ছুটিতে রয়েছেন। তথ্য অনুযায়ী এই ৫ বিভাগে এক-দ্বিতীয়াংশ শিক্ষক শিক্ষা ছুটিতে আছেন। একইভাবে ইইই, এমআইএস, সমাজবিজ্ঞান, শিক্ষা-প্রশাসনসহ আরও কয়েকটি বিভাগেও ছুটির হার ৩৫–৪৫ শতাংশের মধ্যে। যা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউজিসি নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্গন, এমনটাই বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়াও, ফিশারিজ এন্ড মেরিন সাইন্স বিভাগে ৩৭.৫ শতাংশ, এপ্লায়েড ক্যামেস্ট্রি এন্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ৩৬.৩৬ শতাংশ, ফলিত গণিত বিভাগে ৩৫.২৯ শতাংশ, বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ৩৫ শতাংশ, ইনস্টিটিউট অফ ইনফরমেশন টেকনোলজিতে ৪৬.১৫ শতাংশ, ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ৪৫.৪৫ শতাংশ, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগে ৪৪.৪৪ শতাংশ, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে ৪২.৮৫ শতাংশ ও শিক্ষা-প্রশাসন বিভাগে ৪০ শতাংশ শিক্ষক ইউজিসি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম বহির্ভূতভাবে শিক্ষা ছুটিতে রয়েছেন।
রেজিস্ট্রার দপ্তরের তথ্যানুসরারে, নোবিপ্রবির মোট ৪১৪ জন শিক্ষকের মধ্যে শিক্ষাছুটিতে আছেন ১৩০ জন শিক্ষক। এরমধ্যে, ১২২ জন শিক্ষাছুটিতে, পাঁচজন মাতৃত্বকালীন ছুটি, ছুটির অব্যাহতি চলমান দুই জন, চিকিৎসা ছুটিতে রয়েছেন এক জন। এছাড়াও ৪ জন শিক্ষক একাডেমিক ও প্রশাসনিক সকল কার্যক্রম থেকে বিরত রয়েছেন। যা মোট শিক্ষকের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। ফলে শিক্ষক সংকটে নিয়মিত পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে অনেক বিভাগে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে-বাইরে সমালোচনা উঠেছে যে, নিয়ম ভেঙে শিক্ষক ছুটি অনুমোদনের কারণে শিক্ষার্থীরা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অবিলম্বে ছুটি নীতিমালার কঠোর প্রয়োগ না করলে নোবিপ্রবির শিক্ষার মান আরও নিম্নগামী হবে। বিভাগভিত্তিক শিক্ষক সংখ্যা কমে যাওয়ায় নিয়মিত ক্লাস ও পরীক্ষা অনুষ্ঠানে বিঘ্ন ঘটছে, দেখা দিয়েছে সেশন জট।
এদিকে সম্প্রতি শিক্ষক নিয়োগের দাবিতে সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন থেকে বিভিন্ন দাবি জানিয়েছে। শিক্ষাছুটির অনুমোদনে নীতিমালা ভঙ্গ ও ভারসাম্য না থাকলে সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হন শিক্ষার্থীরাই।
রেজিস্ট্রার দপ্তরের তথ্য বলছে, নোবিপ্রবির মোট শিক্ষকের মাইক্রোবায়োলজী বিভাগের ১২ জন, অর্থনীতি বিভাগের ১০ জন, ফিমস বিভাগের ৯ জন, ফার্মেসী বিভাগের ৮ জন, এসিসিই বিভাগের ৮ জন,ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের ৭ জন, বাংলা বিভাগের ৭ জন, বিজিই বিভাগের ৭ জন, আইআইটি ইনস্টিটিউটে ৬ জন,ফলিত গণিত বিভাগের ৬ জন, সিএসটিই বিভাগের ৫ জন, ইএসডিএম বিভাগের ৫ জন,এফটিএনএস বিভাগের ৫ জন,ইইই বিভাগের ৫ জন শিক্ষক শিক্ষা ছুটিতে আছেন।
অন্যবিভাগ গুলো হলো – আইসিই বিভাগ ও এমআইস বিভাগে ৪ জন করে শিক্ষক। ইংরেজি বিভাগ, কৃষি বিভাগ,বিএমবি বিভাগ, পরিসংখ্যান বিভাগ এবং সমাজবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষা ছুটিতে রয়েছে ৩ জন করে শিক্ষক , রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ওশানোগ্রাফি বিভাগ, টিএইচএম বিভাগ এবং শিক্ষা প্রশাসন বিভাগে দুইজন ২ জন করে শিক্ষক , আইআইএস ইনস্টিটিউট, শিক্ষা বিভাগ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ এবং মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ১ জন করে শিক্ষকসহ মোট ১৩০ জন শিক্ষক শিক্ষাছুটি ও মাতৃত্বকালীন ছুটিতে রয়েছে। এছাড়াও ৪ জন শিক্ষককে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা হয়েছে। মোট হিসেবে দাঁড়ায় ১৩৪ জন শিক্ষক। যা মোট শিক্ষকের ৩২.৩৭ শতাংশ।
নোবিপ্রবি শিক্ষা শাখার তথ্য অনুসারে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১০ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত হওয়া উচিত ১:২০। কিন্তু নোবিপ্রবিতে তা নেমে এসেছে ১:৩৬ এ। অর্থাৎ প্রতি ৩৬ জন শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র একজন শিক্ষক। যা শিক্ষার মানকে সরাসরি প্রভাবিত করছে।
সংশ্লিষ্ট শিক্ষা গবেষকরা বলছেন, উচ্চশিক্ষার ছুটিতে শিক্ষকের জ্ঞানের পরিধি বাড়ে। কিন্তু সমস্যা হয় যখন ভারসাম্য রক্ষা না করে ছুটি মঞ্জুর করা হয়। একটি বিভাগ যদি ১৩ জন শিক্ষকের মধ্যে ৭জনকেই ছুটি দেন, তাহলে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
নোবিপ্রবির জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, “শিক্ষকরা যখন শিক্ষা ছুটিতে যাচ্ছেন, তখন তারা অবশ্যই কোনো না কোনো স্কলারশিপ নিয়েই যাচ্ছেন। একটি স্কলারশিপ অর্জন করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। সেই কারণে কেউ স্কলারশিপ পেলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাকে শিক্ষা ছুটি দিয়ে থাকে। তবে বর্তমানে ইউজিসি শিক্ষকদের নতুন পদ খুব বেশি দিচ্ছে না। যেসব বিভাগে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, সেখানে যদি ইউজিসি নতুন শিক্ষক পদায়ন করে, তাহলে এই সংকট দূর হবে।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় বিপ্লব ঘটাতে হলে প্রথমেই শিক্ষকদের গবেষক হতে হবে। সেই ক্ষেত্রে পিএইচডি ডিগ্রি অত্যন্ত জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক র্যাংকিং-এ এগিয়ে নিতে হলে শিক্ষকদের পিএইচডি অপরিহার্য।”
তিনি আরও বলেন, “বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। ইউজিসি যদি এসব বিভাগে নতুন শিক্ষক পদায়ন করে, তাহলে শিক্ষক সংকট কেটে যাবে। ইতোমধ্যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ইউজিসির কাছে দাবি জানিয়েছে। ইউজিসি শিক্ষক সংখ্যা বাড়ালে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে, অন্যদিকে শিক্ষকরাও গবেষণার মাধ্যমে নোবিপ্রবিকে আরও এগিয়ে নিতে সক্ষম হবে।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নোবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, ” বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে এক-তৃতীয়াংশের বেশি শিক্ষক শিক্ষা ছুটিতে যেতে পারেন না। তবে শিক্ষকরা যখন স্কলারশিপ পান কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন হয়, তখন কিছু ক্ষেত্রে আমরা সংখ্যার অনুপাতে কিছুটা ফ্লেক্সিবল হই। যেহেতু এটি উপকূলীয় বিশ্ববিদ্যালয়, এখানে সবসময় স্কলারশিপ পাওয়ার সুযোগ থাকে না। সেই দিকটি বিবেচনায় রেখে আমরা মূলত এক-তৃতীয়াংশ নীতিই অনুসরণ করছি। তবে বিশেষ প্রয়োজনে ব্যতিক্রমও করা হয়।”
কিছু বিভাগে ৫০ শতাংশের বেশি শিক্ষক শিক্ষা ছুটিতে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আগের প্রশাসনের সময় হয়েছে। এখন আমরা আগের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো শিক্ষা কার্যক্রম যাতে ব্যাহত না হয়। তাই স্কলারশিপ না পেলে এবং একান্ত প্রয়োজন ছাড়া আমরা এক-তৃতীয়াংশের বেশি শিক্ষা ছুটি দিচ্ছি না।’