নিয়িমিত চেম্বারে ডাক্তার না থাকা,দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য ও অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানান সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে যশোরের শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে দূরদূরান্ত থেকে চিকিৎসা নিতে আসা সাধারণ রোগীরা। নিম্নমানের সেবা ও ভোগান্তির কারণে এ হাসপাতালের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ভেঙে পড়ছে দিন দিন।
জানা যায়, ১৯৬০ সনের দিকে উপজেলার বুরুজবাগান গ্রামে ৩১ শয্যা দিয়ে যাত্রা শুরু করে স্ব্যাস্থ কমপ্লেক্সটি তবে বর্তমানে শয্যা সংখ্যা ৫০- এ উন্নীত করা হয়েছে।
শয্যা বৃদ্ধি পেলেও চিকিৎসক ও জনবল সংকট, ভাঙাচোরা অবকাঠামো আর অনিয়মের কারণে হাসপাতালটি কার্যত ‘ধ্বংসস্তূপে’ পরিণত হয়েছে।
সরোজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সার্জারি যন্ত্রপাতির ঘাটতি, ওয়ার্ডে পানি-বিদ্যুতের সমস্যা, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, ময়লা-দুর্গন্ধযুক্ত বাথরুমসহ নানা অব্যবস্থাপনায় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে রোগীদের। এছাড়া প্যাথলজি বিভাগ থাকলেও বেশিরভাগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রোগীদের বাইরে পাঠানো হয় বলে জানা যায়।
এ বিষয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা জাহানারা খাতুন নামের এক রোগী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, জরুরি বিভাগ থেকে ডাক্তার কয়েকটি পরীক্ষা করতে বলেন, কিন্তু সেগুলো করতে বাইরে যেতে হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে এসে বাইরে ঘুরতে হবে কেনো,এটাই কি সেবা?
অন্যদিকে অসুস্থ শাশুড়িকে নিয়ে আসা ফারিবা আক্তার নামের আরেকজন বলেন, সকাল আটটায় এসেছি, সাড়ে ১১টা বাজলেও এখনো ডাক্তারের দেখা মেলেনি। লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, আরও ৩০ জনের পরে দেখা হবে। এত দেরিতে কীভাবে চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব?
রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ, হাসপাতালের পরিবেশ একেবারেই অস্বাস্থ্যকর। অধিকাংশ বেড ভাঙা ও জোড়াতালি দেওয়া, বাথরুম নোংরা ও অকার্যকর। রাতে ফ্যান ও লাইট না থাকায় হাসপাতাল অন্ধকারে ভুতুড়ে পরিবেশ ধারণ করে। এদিকে হাসপাতালের চারটি কেবিন সবসময় প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের দখলে থাকে। এই সিন্ডিকেটকে ‘ম্যানেজ’ করতে পারলেই কেবল কেবিন পাওয়া যায় বলে জানা যায়।
এছাড়া, ভর্তি রোগীদের জন্য প্রতিদিন সরকারি খরচে খাবার সরবরাহ করা হলেও তা মানসম্মত নয়। তালিকাভুক্ত খাবার দেওয়া হয় না, যেসব খঅবার দেওয়া হয় তা মুখে দেওয়ার মতো নয় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। ফলে রোগীরা বাইরে থেকে কিনে বা বাড়ি থেকে এনে খেতে বাধ্য হন।
বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়ার নিয়ম থাকলেও নামমাত্র সরবরাহ করা হয়। গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা এমন মৌলিক জিনিসও রোগীদের বাইরে থেকে কিনতে হয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, দালাল ও প্রভাবশালী সিন্ডিকেট চক্র স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে জিম্মি করে রেখেছে। ওষুধ ও যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় প্রতিবছর লাখ লাখ টাকার দুর্নীতি হয়। টেন্ডারে উল্লেখিত মানের জিনিস না দিয়ে নিম্নমানের সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়। এমনকি স্টোরে কোটি টাকার সম্পদ থাকলেও নাইট গার্ড নেই, যে কারণে চুরির ঝুঁকি সবসময় বিরাজ করছে।
বর্তমানে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পর্যাপ্ত চিকিৎসক নেই। যাঁরা আছেন, তাঁদের অনেকেই নিয়মিত রোগী দেখেন না। অফিস সময়ে প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখাকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় সাধারণ মানুষকে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্যও প্রাইভেট ক্লিনিক বা শহরের হাসপাতালের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে।
এক ভুক্তভোগী রোগীর স্বজন বলেন, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার আশায় এসেছিলাম। কিন্তু এখানে নেই সঠিক চিকিৎসক, নেই মানসম্মত খাবার, নেই পর্যাপ্ত ওষুধ। সবকিছুই সিন্ডিকেটের দখলে।
এমন পরিস্থিতিতে শার্শার সাধারণ মানুষ সরকারি স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। জরুরি সংস্কার, পর্যাপ্ত চিকিৎসক নিয়োগ, দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য বন্ধ এবং স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা না হলে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির প্রতি মানুষের আস্থা ফেরানো সম্ভব নয় বলে মনে করছেন স্থানীয় সচেতন মহল।
রোগীদের নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহের বিষয়টি স্বীকার করে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার তৌফিক পারভেজ জানান, আমাদের হাসপাতালে একই ঠিকাদার দীর্ঘদিন ধরে খাদ্য সরবরাহ করছে।তাদেকে বারবার নিম্নমানের খাদ্য না দিয়ে ভালো খাদ্য দেওয়ার তাগিদ দেওয়া হলেও তারা গুরুত্ব দিচ্ছে না। ঠিকাদারের বিষয়টি উর্ধতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।তবে হাসপাতালে টেষ্ট না করিয়ে রোগীদের বাহিরে টেষ্ট করতে পাঠানোর বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।