বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

খালেদা জিয়া: বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক 

জাহিদ হাসান শাকিল
-বিজ্ঞাপণ-spot_img

বাংলাদেশের ইতিহাসে গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের দ্বন্দ্ব সবসময়ই একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। এই দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে একদিকে যেমন জনগণের মুক্তিকামী চেতনা উন্মোচিত হয়েছে, অন্যদিকে আবার বারবার সামরিক হস্তক্ষেপ, একদলীয় শাসন ও বিদেশি প্রভাব রাজনীতিকে দুর্বল করেছে। এই দীর্ঘ সংগ্রামের ভেতরে একজন নারী নেত্রী, বেগম খালেদা জিয়া, আবির্ভূত হয়েছেন আপোষহীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রতীকে। 

বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে তিনি শুধু একজন দলের নেত্রী নন বরং তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মূল প্রতীক এবং আপোষহীন নেতৃত্বের প্রতিমূর্তি।

 আজ তার ১৮তম কারামুক্তি দিবস।

 ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং আদালত তার জামিন নামঞ্জুর করলে সংসদ ভবন এলাকায় একটি পরিত্যক্ত বাড়িকে সাব-জেল করে সেখানে বন্দি করে রাখা হয়। পরবর্তীতে ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জনগণের চাপের মুখে মুক্তি দেওয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকার তাকে বিদেশে পাঠাতে চাইলেও, এমনকি সন্তানদের জীবননাশের হুমকি দিয়েও, তিনি দেশ ছাড়তে রাজি হননি। ফলে কথিত মাইনাস-টু ফর্মুলা ব্যর্থ হয়ে যায়।

১৯৮১ সালের ৩০ মে স্বাধীনতার ঘোষক ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর বিএনপি কার্যত নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে। মাত্র ৩৬ বছর বয়সী গৃহবধূ খালেদা জিয়া তখন নিছকই দলের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং ১৯৮৪ সালের ১০ মে বিএনপির চেয়ারপারসন হন এবং স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি দ্রুত জাতীয় রাজনীতিতে গ্রহণযোগ্যতা পান। তাঁর এই রাজনৈতিক অভিষেক ছিল বাংলাদেশের নারী নেতৃত্বের এক নতুন সূচনা।  

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর ক্ষমতার রাশ হাতে নেন বেগম খালেদা জিয়া। একজন গৃহিণী থেকে জাতীয় নেতৃত্বে উঠে আসার এই যাত্রা নিছক ব্যক্তিগত কাহিনি নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণ ও রাষ্ট্রের নতুন দিকনির্দেশনার প্রতীক। এর আগে রাজনৈতিক নেতৃত্বে নারীর উপস্থিতি ছিল প্রতীকী পর্যায়ে সীমাবদ্ধ; কিন্তু খালেদা জিয়া তিন দফা প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেখিয়েছেন যে বাংলাদেশে নারীর নেতৃত্ব কেবল ব্যতিক্রম নয় বরং জনগণের গ্রহণযোগ্য বাস্তবতা।

তাঁর প্রথম আমল (১৯৯১-১৯৯৬) ছিল বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার সময়। এর আগে এক দশকের সামরিক শাসন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে দিয়েছিল। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়, সেখানে দেখা যায় জনগণ সত্যিকার অর্থে একনায়কতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন এবং রাষ্ট্রপতির একক ক্ষমতা হ্রাসে সাংবিধানিক সংশোধন ছিল এই সময়ের বড় অবদান। নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের তুলনামূলক উন্মুক্ত পরিবেশও তখন গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভিত্তি মজবুত করেছিল।

অর্থনৈতিক দিক থেকেও খালেদা জিয়ার শাসনামল গুরুত্বপূর্ণ। ৯০’র দশকের গোড়ায় বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪-৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও কৃষি খাতে স্বনির্ভরতা অর্জন, পোশাকশিল্পের বিস্তার, রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ধারা এবং নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কারণে অর্থনীতিতে গতি আসে। বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে মাইক্রোক্রেডিট, এনজিও কার্যক্রম এবং শিল্পোদ্যোগের বিস্তার বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোয় নতুন সম্ভাবনা তৈরি করে। যদিও দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অদক্ষতা তখন থেকেই সমালোচনার বিষয় হয়ে ওঠে, তথাপি এটি ছিল প্রবৃদ্ধির ভিত গড়ে তোলার যুগ।

রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এই সময়েই আরও তীব্র হয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বন্দ্ব ক্রমশ রাষ্ট্র পরিচালনার মূল বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনী প্রহসনের অভিযোগে ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও খালেদা জিয়ার সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়, আর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এখানেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষায় রাজনৈতিক আপস অপরিহার্য এবং খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার এই বিতর্কের মধ্য দিয়েই আরও জটিল হয়ে ওঠে।

২০০১ সালে তিনি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতির নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ এবং আন্তর্জাতিক চাপ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। যুক্তরাষ্ট্রের ৯/১১ পরবর্তী বৈশ্বিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে বাংলাদেশকেও আন্তর্জাতিক দৃষ্টির কেন্দ্রে থাকতে হয়। বিএনপি সরকার একদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখলেও অন্যদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন, নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক এবং জঙ্গিবাদ দমনে ব্যর্থতার অভিযোগে সমালোচিত হয়। তবুও রাজনৈতিকভাবে এই সময় বিএনপির শক্তি বিস্তৃত ছিল গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত।

২০০৮ সালের পর থেকে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ভূমিকা মূলত প্রতিরোধের রাজনীতি। ক্ষমতাসীনদের একচেটিয়া আধিপত্যের বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলন, নির্বাচন ও গণআন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্র রক্ষার চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে খালেদা জিয়ার প্রতীকী অবস্থান নতুনভাবে আলোচনায় আসে। যদিও শারীরিক অসুস্থতা ও বয়সজনিত কারণে তিনি সরাসরি মাঠে থাকতে পারেননি, তবুও বিএনপির তৃণমূল থেকে সাধারণ জনগণ তাকে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, গণতন্ত্রের আন্দোলনে তার উপস্থিতি যেন এক মাদার ফিগার, যা জনগণের মনে আশার সঞ্চার করে।

আন্তর্জাতিক পরিসরেও তাঁর নেতৃত্ব ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন ও ভারতের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি, মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রসার এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সক্রিয় ভূমিকা বাংলাদেশকে বৈশ্বিক অঙ্গনে শক্তিশালী অবস্থান দেয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় খালেদা জিয়া কখনো বিদেশি চাপের কাছে নতি স্বীকার করেননি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল থেকে শুরু করে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট পর্যন্ত নানা সংস্থা বাংলাদেশে গণতন্ত্র, দুর্নীতি ও মানবাধিকারের সূচক প্রকাশ করেছে। এসব সূচকে কখনো উন্নতি, কখনো অবনতি ঘটলেও খালেদা জিয়ার শাসনকাল একটি ট্রানজিশনাল ডেমোক্রেসির উদাহরণ হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে। অর্থাৎ যেখানে গণতন্ত্রের কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হলেও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল নড়বড়ে।

সর্বোপরি, খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে কেবল একজন দলীয় নেত্রী নন; তিনি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারক, নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক এবং রাজনৈতিক ইতিহাসের অপরিহার্য চরিত্র। তার উত্তরাধিকারকে কেউ সমালোচনা করে, কেউ প্রশংসা করে; কিন্তু তাকে এড়িয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়। বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রেক্ষাপটে খালেদা জিয়ার নাম উচ্চারিত হবে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায়, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে এখনও পর্যন্ত প্রভাবিত করছে।

লেখা: জাহিদ হাসান শাকিল

যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, কেন্দ্রীয় সংসদ

শেয়ার করুন

সর্বশেষ নিউজ

রাজনীতি নিষিদ্ধ গকসুর রাজনৈতিক ভিপি প্রার্থীরা

গবি সংবাদদাতাগণ বিশ্ববিদ্যালয়ে (গবি) রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও আসন্ন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (গকসু) নির্বাচনে ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) পদে মনোনয়ন নেওয়া একাধিক প্রার্থীর রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে...

রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসে নবীন শিক্ষার্থীদের নিয়ে শিবিরের আলোচনা সভা

‎পাবিপ্রবি প্রতিনিধিপাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবিপ্রবি) অভ্যন্তরে সকল প্রকার রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার পরেও হঠ্যাৎ করেই শিবিরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ উঠেছে।গতকাল বুধবার...

পটুয়াখালীতে ঘুষের ভিডিও ধারণকালে সাংবাদিকের মোবাইল ছিনিয়ে নিলেন ভূমি কর্মকর্তা

পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার সদর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ঘুষ নেয়া ও নিজস্ব দালাল চক্রের সদস্যের ভিডিও ধারণের সময় সাংবাদিকদের উপরে হামলা করে মোবাইল ফোন ছিনিয়ে...

বেরোবিতে অনুমোদনবিহীন ভর্তি: অনিশ্চয়তায় ২০৫ গবেষক

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) এমফিল, পিএইচডি ও পোস্ট ডক্টরালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অনুমোদন না থাকলেও ২০১২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মোট ২০৫...

সম্পর্কিত নিউজ

রাজনীতি নিষিদ্ধ গকসুর রাজনৈতিক ভিপি প্রার্থীরা

গবি সংবাদদাতাগণ বিশ্ববিদ্যালয়ে (গবি) রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও আসন্ন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (গকসু) নির্বাচনে ভাইস...

রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসে নবীন শিক্ষার্থীদের নিয়ে শিবিরের আলোচনা সভা

‎পাবিপ্রবি প্রতিনিধিপাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবিপ্রবি) অভ্যন্তরে সকল প্রকার রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার পরেও...

পটুয়াখালীতে ঘুষের ভিডিও ধারণকালে সাংবাদিকের মোবাইল ছিনিয়ে নিলেন ভূমি কর্মকর্তা

পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার সদর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ঘুষ নেয়া ও নিজস্ব দালাল চক্রের সদস্যের...