বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) এমফিল, পিএইচডি ও পোস্ট ডক্টরালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অনুমোদন না থাকলেও ২০১২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মোট ২০৫ জনকে ভর্তি করে বিপাকে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অনুমোদন ছাড়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিষয়টি ১০ বছর গোপন থাকলেও ২০২৪ সালের মাঝামাঝিতে তা প্রকাশ্যে আসে।
পরে গত বছরের ১৬ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ওয়াজেদ ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (বর্তমান ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ এক্সিলেন্স) অধীনে গবেষণার জন্য ভর্তির অনুমোদন মেলে। ফলে পূর্বে ভর্তি হওয়া ২০৫ জনের অনুমোদন না থাকায় অনিশ্চয়তায় দিন গুনছেন তারা।
বিষয়টির সুরাহা করতে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে ইউজিসি চেয়ারম্যানের কাছে।
অনুমোদবিহীন গবেষকদের সাথে বর্তমান উপাচার্য দুই দফায় মিটিং করার পর ইউজিসির নিকট অনুমোদন ছাড়া ভর্তি হওয়া ২০৫ গবেষকদের ভূতাপেক্ষ অনুমোদনের জন্য আবেদন জানালে ইউজিসি আরেকটি ফিরতি চিঠিতে জানানো হয়, ভূতাপেক্ষ অনুমোদনের কোন সুযোগ নেই।
তবে ইউজিসির এই সিদ্ধান্তের ফলে ২০৫ গবেষকের ডিগ্রি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে।
গবেষকরা বলছেন, তারা অনেকেই ৮/১০ বছর ধরে গবেষণা কার্যক্রম করছেন, অনেকেই আবার গবেষণা কার্যক্রম শেষ করেছেন, এখন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছেন। ইউজিসির এই সিদ্ধান্তের ফলে সময় ও আর্থিক ক্ষতির মধ্য পড়ছেন গবেষকেরা।
জানা গেছে, ২০০৯ সালের ৩ ডিসেম্বর ১০ সিন্ডিকেট সভার নবম সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ড. ওয়াজেদ ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ইনস্টিটিউট থেকে এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রি দিতে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এরপর ২০১১ সালের ৩ নভেম্বর ২০তম সিন্ডিকেট সভায় নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১২ সালের ৭ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ২০১১-২০১২ শিক্ষাবর্ষ থেকে এমফিল, পিএইচডিতে ভর্তি করানো হয়।
ওয়াজেদ ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা যায়, প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ড. ওয়াজেদ ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এসব ব্যাচে এমফিল, পিএইচডি ও পোস্ট ডক্টরাল গবেষক ভর্তি হন ২০৫ জন। তাদের মধ্যে ২০১১-২০১২ সেশনে ১৬ জন, ২০১৮-২০১৯ সেশনে ৩৭ জন, ২০১৯-২০২০ সেশনে ৭১ জন, ২০২০-২০২১ সেশনে ৪৪ জন, ২০২১-২০২২ সেশনে ৩৭ জন ভর্তি হন। ২০১২ থেকে ২০২২ শিক্ষাবর্ষে তাদের ভর্তি করা হলেও ড. ওয়াজেদ ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের অধীনে ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয় ২০২৪ সালের ১৬ মে।
ফলে আগের ১০ বছরে ভর্তি হওয়া ব্যক্তিদের কোনো ডিগ্রি অর্জন করার সুযোগ থাকছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সিনিয়র শিক্ষকের জানান, গবেষণার জন্য অনুমোদন না থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল জলিল মিয়ার আমলে এই ভর্তি শুরু হয়। প্রথম কর্মকর্তা হন তার মেয়ে। পরে ড. ওয়াজেদ ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট খুলে এর অধীনে গবেষক ভর্তি করানো হয়।
জানা গেছে, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়া ড. ওয়াজেদ ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটে গবেষণার জন্য ভর্তি হয়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা, বিভিন্ন সরকারি কলেজের শিক্ষক, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
ভর্তি হওয়ায় অনেকের ছুটি শেষ হয়েছে। অনেকেই গবেষণা শেষ করতে পারেননি, গবেষণাপত্র জমা দিতে পারেননি। এমন অনেকেই আছেন যে গবেষণা শেষ করতে না পারায় প্রতিষ্ঠানে বেতন ভাতা ফেরত দিতে চিঠিও পেয়েছেন।
তারা বলেন, ‘আমরা সার্কুলার দেখে ভর্তি হয়েছি। ২০১২ সালে ভর্তি হলেও অদ্যবধি কোনো সুরহা হয়নি। আমাদের অপরাধটা কোথায়? আমরা সব নিয়ম মেনে ভর্তি হয়েছিলাম। এর দায় বিশ্ববিদ্যালয়ের।
গবেষণা প্রোগ্রামে ভর্তি হওয়া গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুল হক বলেন, ভূতাপেক্ষ অনুমোদনের জন্য যারা চিঠি পাঠিয়েছিলেন তাদের আইনি জ্ঞান স্পষ্টতই নেই। ইউজিসির এই চিঠিই তার প্রমাণ। কোনো প্রতিষ্ঠান কখনো ভূতাপেক্ষ অনুমোদন পায় না; ভূতাপেক্ষভাবে অ্যাবজর্ব করা যায় কেবল শিক্ষার্থী বা ফেলোদের, প্রতিষ্ঠানকে নয়। কোনো প্রতিষ্ঠানের পূর্বে অনুমোদন না থাকলেও ফেলো ভর্তি হতে পারে। অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানের ফেলোদের ইউজিসি ফেলোশিপ দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কেউ একটি স্কুল খুললেন এবং ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি দিয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় অনুমোদন পেলেন। এখন কি সেই শিক্ষার্থীদের আবার ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে শুরু করতে হবে? নতুন করে ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ার প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশে এরকম শত নজির রয়েছে। আইন সর্বদা এক।
তিনি আরও বলেন, অনুমোদন ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় গবেষক ভর্তি করলো কেন? এটা নিছক প্রতারণা ও ক্রিমিনাল অফেন্স। যেকোনো গবেষক ফেলো চাইলে প্রতারণা ও ক্ষতিপূরণ মামলা করতে পারেন সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। ভর্তির লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় সেটাও ফৌজদারি অপরাধ।
২০১২ সালে গবেষণা প্রোগ্রামে ভর্তি হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক বলেন, আমি যথাযথ নিয়ম মেনে পিএইচডি প্রোগ্রাম এ ভর্তি হয়েছি এবং আমি থিসিসও জমা দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমি ন্যায়বিচার চাই।
আরেক শিক্ষার্থী রংপুর সরকারি কলেজের শিক্ষক মাহাতার হোসেন সুজন বলেন, অনুমোদন আছে কি মেয়ে সেটা তো আমরা জানি না। পত্রিকায় সার্কুলার পেয়েছি আমরা আবেদন করেছি। আমাদের সকল কাজ শেষ আমরা থিসিসও জমা দিয়েছি। তাহলে কেন এত বছর পর এসে বলবে যে সেটার অনুমোদন নেই। তাহলে কেন আমাদের ভর্তি করানো হলো। এখন তো আমাদের আইনের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় দেখছি না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শওকাত আলী বলেন, এ ব্যাপারে আমার কিছু করার নেই। আমি দুইবার চেষ্টা করেছি। ব্যর্থ হয়েছি। এখন আমরা নতুন করে সার্কুলার দেব। কেউ চাইলে এখানে রি অ্যাডমিশন নিতে পারবেন।